পাতা:প্রবাসী (চতুর্বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৪০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রুদ্ধ গৃহ হরিহর কলেজ হইতে সবে পাশ করিয়া বাহির হইয়াছিল। কলিকাতার একটু বাহিরের দিক্‌ ঘোঁসিয়া অল্প ভাড়ায় ছুইখানি ঘর লইয়া দোলের গায়ে নূতন পিতলের সাইন বোর্ড অঁাটিয়া সে ডাক্তার সাজিয়া বসিয়াছিল । বসিবার ঘরে চেয়ার ছিল, টেবিল ছিল, মেটিরিয়া মেডিকা ছিল, ঔষধের খালি ও ভৰ্ত্তি শিশি ছিল, যন্ত্রপাতিও কিছু কিছু ছিল, কিন্তু রোগীর দর্শন মিলিত না। তাই এই ঘরটার চাইতে চটের ঈজি চেয়ারশোভিত দুই হাত চওড়া পথমুখী বারান্দাটির প্রতিই নবীন ডাক্তারের বেশী টান ছিল ; যদিচ সেখানেও ঈজি চেয়ারের বুকে পড়িয়া নিজের শূন্য মন্দিরের ধ্যান করিতে তাহার বেশী ক্ষণ ভাল লাগিত না । তাই বেশীর ভাগ সময় তাহার দিন কাটিত বারান্দার রেলিং ধরিয়া ঝু কিয়া পথের পানে চাহিয়া চাহিয়া, নয় হাতের তেলোয় মুখ রাখিয়া আশে পাশের বাড়ীগুলির অন্দরের রহস্য উৎঘাটনে মন লাগাইয়া । হরিহরের বাড়ীর একপাশে ছিল পোড়ে একটা মাঠের মধ্যে সাতকালের ভাঙা একটা মসজিদ । তার গা বাহিয়া আকন্দ ফুলের মাল। আপনি ফুটিয়া উঠিত, বুক চিরিয়া নিত্য নূতন অশ্বখ বৃক্ষের কচি পাতা দেখা দিত ; প্রতি সন্ধ্যায় তার জীর্ণ দেহের অসংখ্য ফাটলের অন্ধকারকে নিবিড় করিয়া দেখাইবার জন্য পদতলে ছোট দুটি মাটির প্রদীপ জলিয়া উঠিত ; কিন্তু ইহার মধ্যে হরিহর কোনো রহস্য খুজিয়া পাইত ন, কোনো রোমান্সের ভিত্তির সন্ধানও করিত না । বাড়ীর আর-এক পাশে ছিল, বাক্স-বিক্রেতা জয়কৃষ্ণ বাবুর দুই পক্ষের বিশাল পরিবার । আটটি মসী-নিন্দিতবর্ণ কন্যা ও পাচটি আবলুস-নিন্দিত পুত্রের উপর পৌত্র পৌত্রী বধূ জামাতায় মিলিয়া ক্ষুদ্র দ্বিতল গৃহখানির আনাচ-কানাচ এমন পরিপূর্ণ করিয়া রাখিত, যে, সত্যই সেখানে ছুচ ফেলিবার জায়গা পাওয়া যাইত না। ভোর না হইতে জল-তোলা, বাসন-মাজা, উনান-ধরানো, আপিসের ভাত বাড়ার কলরব মুরু হুইত, সন্ধ্যা গড়াইয়া রাত্রির কোলে ঢলিয়া পড়িলেও চুল বাধা, গা ধোওয়া, ছেলে পিটোনো, ও বাবুর পায়ে তেল মালিশ প্রভৃতির সশব্দ পৰ্ব্ব সমাপন হইত না। বাড়ীর মধ্যে এমন কোনো মানুষ কি সময় কি স্থান ছিল না যাহার গায়ে রং ফলাইয়াও রহস্যময় করিয়া তোলা যায়। সে সংসারের স্থান কাল কি পাত্রের ধারার মধ্যে এমন কোনো ফাক পাওয়া যাইত না যেটুকুকে রসে রহস্তে গড়িয়া তুলিয়া কল্পনার পোরাক যোগান যায় । হরিহরের বাড়ীর মুখোমুখি গলির ওপারের বাড়ীখানাই ছিল তার সব কল্পনার উৎস। দিনের পর দিন এই উচু পাচিলে ঘেরা বিশাল স্তব্ধ বাড়ীটার প্রচ্ছন্ন সংসারযাত্রার চক্রের শব্দহীন গতি সে অহুভব করিত, কিন্তু কোন পথে কোথায় কাহাকে অবলম্বন করিয়া যে সে সংসার চলিয়াছিল, হরিহর তাহ খুজিয়া পাইত না। তাহার কল্পনা আজ যাহা গড়িত, কাল তাহা ভাঙিয়া ফেলিত, রহস্য-জাল দিনকার দিন জটিল হইতে জটিলতর হইয়া উঠিত । রাস্তার ধারে লালচে রঙের প্রকাণ্ড দোতলা চকুমিলানো বাড়ী - সারি সারি শাশী খড়খড়ি অন্ধের চোখের মত দেয়ালের গায়ে সাজানো, দিনের আলো কবে কোন যুগে যে তাহার বন্ধন মোচন করিয়া অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করিয়াছিল তাহা হয়ত ইতিহাস খুজিলে বলা যায়। তাহার পর আজ কতকাল ধরিয়া নিত্য প্রাতে তরুণ অরুণ তাহার আলোর অঞ্জলি আনিয়া বাতায়ন পথে নিবেদন করিতেছে, কিন্তু রুদ্ধ কবাট মুক্ত করিয়া সে অর্ঘ্য গ্রহণ কোনো কল্যাণী গৃহলক্ষ্মীকে করিতে দেখা যায় না। চিরকাল পরীক্ষার পড়া করিয়া, হরিহরের ভোর ন হইতেই ঘুম ভাঙিয়া যাওয়ার রোগ দাড়াইয়া গিয়াছিল। বিছানা পড়িয়া পড়িয়া পলাতক ৩৬৫