পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/১৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯৮ অংশে শ্রেষ্ঠ নহে। ইহার দেবপাল ও ধৰ্ম্মপালের রাজত্বকালে জীবিত ছিলেন। পিতাপুত্র উভয়েই প্রস্তর ও ধাতুমূৰ্ত্তি নিৰ্ম্মাণে, এবং চিত্রাঙ্কণে দক্ষ ছিলেন। বিংপালো ( বীতপাল) বঙ্গদেশে বাস করিতেন এবং তিনি ধাতুমূৰ্ত্তি নিৰ্ম্মাণের পূৰ্ব্বদেশীয় রীদির শ্রেষ্ঠ (স্থাপয়িত ) বলিয়া-গণিত হইতেন । মগধে তাহার চিত্রাঙ্কণ পদ্ধতির বহু ছাত্র ছিল বলিয়। তিনি পরবর্তীকালের মধ্যদেশের প্রধান চিত্রকর এবং তাহার পিত৷ পূৰ্ব্বদেশের চিত্রকরগণের প্রধানরূপে গণ্য হইতেন।” তারানাথের ইতিহাসের "মূৰ্ত্তিনিৰ্ম্মাণ পদ্ধতির উৎপত্তি” নামক চতুৰ্ব্বিংশতি অধ্যায়ে গৌড়ীয়শিল্প সম্বন্ধে এই কথা দেখিতে পাওয়া যায়। তারানাথের গ্রন্থ ব্যতীত অন্য কোন গ্রন্থে, শিলালিপিতে বা তাম্রশাসনে ধীমান বা বীতপালের নাম পাওয়া যায় নাই। তথাপি গৌড়রাজমালার উপক্ৰমণিকায় ঐযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় বলিয়াছেন, "এই যুগে, বরেন্দ্রমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া [ ধৰ্ম্মপালদেবের এবং দেবপালদেবের শাসন-সময়ে ] ধীমান এবং তৎপুত্র বীতপাল গৌড়ীয়ুশিল্পে যে মনিন্দ্যসুন্দর রচনাপ্রতিভা বিকশিত করিয়াছিলেন, তাহার বিবরণ “শিল্পকলায়” সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। তাহার সন্ধানলাভে অসমর্থ হইয়া, লেখকগণ এই যুগের মগধের এবং উৎকলের শিল্প-নিদর্শনকে মগধের এবং উৎকলের প্রাদেশিক শিল্পপ্রতিভার নিদর্শন বলিয়াই ব্যাখ্যা করিয়৷ আসিতেছেন।” গৌড়বিবরণের শিল্পকলাখণ্ড আদ্যাবধি প্রকাশিত হয় নাই ; কিন্তু বাঙ্গলার শাসনকৰ্ত্ত যখন বরেন্দ্র-অনুসন্ধানসমিতির চিত্রশাল দর্শন করিতে গিয়াছিলেন, তখন উক্ত চিত্রশালার যে তালিকা মুদ্রিত হইয়াছিল, তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায়, বরেন্দ্র-অনুসন্ধানসমিতি স্থির করিয়াছেন তাহাদিগের সংগৃহীত মূৰ্ত্তিসমূহের মধ্যে ধীমাননিৰ্ম্মিত কতকগুলি প্রস্তরমূৰ্ত্তি আছে। এই তালিক ইংরেজিভাষায় লিখিত, ইহাতে সংগৃহীত মূৰ্ত্তিগুলির বিশদ বিবরণ প্রদত্ত আছে। বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি যে কয়টি মূৰ্ত্তি ধীমাননিৰ্ম্মিত মনে করিয়াছেন, তাহার কোনটিতেই খোদিতলিপি নাই ; থাকিলে তালিকায় অবশ্যই তাহার উল্লেখ থাকিত। খোদিত লিপির অভাবে কোন একটি প্রবাসী—জ্যৈষ্ঠ, ১৩২২ [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড মূৰ্ত্তি কি প্রমাণের বলে ব্যক্তিবিশেষের শিল্পনিদর্শনরূপে . . গণ্য হইতে পারে, তাহ উল্লিখিত হয় নাই। যাহারা বিজ্ঞানাচুমোদিত ঐতিহাসিক রচনা প্রণালীর গৰ্ব্ব করিয়া থাকেন, তাহাদিগের লেখনী হইতে কেমন করিয়৷ এই সকল কথা নি:স্থত হইল ? বলা বাহুল্য ইহা ইতিহাস নহে। বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত না হইলে তারানাথের উক্তিও ইতিহাস বলিয়া গ্রাহ হইতে পারে না। রাঢ়ে ও বঙ্গে যেসমস্ত নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার মধ্যে অনেকগুলি বরেন্দ্রভূমিতে আবিষ্কৃত মূৰ্ত্তি অপেক্ষ কোন অংশে হীন নহে। সম্প্রতি শ্ৰীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বস্তু বৰ্দ্ধমান জেলার অট্টহাস গ্রামে একটি প্রস্তরযুক্তি আবিষ্কার করিয়াছেন। মূৰ্ত্তিটি পদ্মাসনে উপবিষ্ট জরাজীর্ণ শীর্ণ নারীমূৰ্ত্তি। মূৰ্ত্তির পাদপীঠে উপাসক ও উপাসিকার মূৰ্ত্তি এবং একটি অশ্ব বা গৰ্দ্দভের মূৰ্ত্তি দেখা যায়। ইহা কোন দেবতার মূৰ্ত্তি তাহ অদ্যাপি নির্ণীত হয় নাই ; কিন্তু মূর্তিটি দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, যিনি ইহা নিৰ্ম্মাণ করিয়াছিলেন তাহার শিল্পপ্রতিভা অসাধারণ। দেবীর কটিদেশে একখানি বস্ত্র আছে, কিন্তু তাহার দেহের উৰ্দ্ধভাগ অনাবৃত। যেরূপ কৌশলের সহিত জীর্ণদেহের পঞ্চরগুলি এবং শীর্ণ স্তনদ্বয় খোদিত হইয়াছে তাঙ্গ৷ দেখিলেই বোধ হয়, যে, দেবীর শ্বাসরুদ্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে। তাহার শীর্ণ অধরপ্রান্তে ক্ষীণ হাস্যরেখা শিল্পীর অপূৰ্ব্ব কলাকৌশলের নিদর্শন। দেবীর কণ্ঠে স্বত্রহারে লম্বিত কবচ এবং মণিবন্ধে সামান্য বলয় ব্যতীত তাহার দেহে অন্য কোন অলঙ্কার নাই, তাহার কেশপাশ আলু লায়িত, গণ্ডদ্বয় শীর্ণ, তথাপি মূৰ্ত্তি হইতে যেন এক অপূৰ্ব্ব প্রভা বাহির হইতেছে। এই জাতীয় মূৰ্ত্তি, এমন অপূৰ্ব্ব শিল্পনিদৰ্শন, ইতিপূৰ্ব্বে গৌড়ে, বঙ্গে, রাঢ়ে অথবা মগধে আবিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। কয়েকবৎসর পূৰ্ব্বে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দী মহকুমায় যে তিনটি পিত্তলময় মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছিল সেরূপ মূৰ্ত্তি ইতিপূৰ্ব্বে বরেন্দ্র ভূমিতে আবিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রোটেনষ্টাইন বলিয়াছেন যে, পৃথিবীর কোন চিত্রশালাতেই এইরূপ অনিন্দ্যমুন্দর ভারতীয় ধাতুমূৰ্ত্তি নাই। কয়েকবৎসর পূৰ্ব্বে ঢাকা জেলার চূড়াইন গ্রামে ਾਂ রাতের বিষ্ণুপ্তি আবিষ্কৃত হইয়াছিল, তাহ এখন ২য় সংখ্যা ] কলিকাতার সরকারী চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। ভারতের অন্য কোন স্থানে এরূপ মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। রাঢ়ে ও বঙ্গে আবিষ্কৃত এই সমস্ত নিদর্শনের প্রমাণের বিরুদ্ধে কেবল তারানাথের উক্তির উপরে নির্ভর করিয়া বরেন্দ্রবাসী ধীমানকে গৌড়ীয় শিল্পরীতির প্রতিষ্ঠাতা নির্দেশ করা বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীর অনুমোদিত হয় নাই। গৌড়ীয় শিল্পের প্রকৃত ইতিহাস এখনও রচিত হয় নাই। গৌড়, বঙ্গ, মগধ, অঙ্গ ও রাঢ়ে একই শিল্পরীতি প্রচলিত ছিল। এই সমস্ত প্রদেশের মূৰ্ত্তিসমূহের বিশেষত্ব বিশ্লেষণ না করিয়া কেবল প্রদেশমাত্রের মূৰ্ত্তি সংগ্ৰহ করিয়া গৌড়ীয় শিল্পরীতির ইতিহাস রচিত হইতে পারে না। পালও সেনবংশীয় রাজগণের নাম- ও রাজ্যাঙ্কসমেত খোদিতলিপিযুক্ত, বহু প্রস্তর ও ধাতুমূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই গুলির সাহায্যে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের কঙ্কাল অবলম্বন করিয়া গৌড়ীয়শিল্পরীতির ইতিহাস রচনা করিতে হইবে, নতুবা তাহা বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে রচিত ইতিহাসরূপে পরিগণিত হইবে না। শ্ৰীহুরেন্দ্রনাথ কুমার । অজন্ত গুহার চিত্রাবলী কাব্যের সহিত ছন্দের যে সম্বন্ধ, চিত্রে মূৰ্ত্তির ভঙ্গিমা ও গঠন-সৌষ্ঠবের সেই সম্বন্ধ । ভাব প্রকাশের পথ ভাষা ; ভাষায় ভাবের সৌন্দর্য্য ফুটাইবার জন্য কবিত্বের প্রয়োজন। সেইরূপ চিত্রশিল্পে ভাব-সৌন্দর্য্যের আভাষ দিবার জন্য গঠন ও ভঙ্গিম-বৈচিত্র্যের প্রয়োজন। কবিতায় যেমন কথার স্বাধুনি ছন্দের অম্ববৰ্ত্ত হয়, চিত্রে তেমনি মূৰ্বর রচনা-কৌশল কোন-এক নির্দিষ্ট আদর্শ গঠনের অনুসরণ করে। কবির মত শিল্পীর প্রথম কাজ চিত্রের বিষয় স্থির করিয়৷ লওয়া । চেষ্টা করিবার পূৰ্ব্বে লক্ষ্য স্থির হওয়া চাই। চিত্রের সমাদর প্রধানত: চিত্রে বর্ণিত বিষয়ের জন্যই হয়। কেবল দক্ষতা বা নৈপুণ্যের আদর অত্যন্ত অল্প। চিত্রের বিষয়টি যদি সুন্দর-ভাব-সম্পন্ন হয়, তাহা হইলে চিত্রাঙ্কনে সামান্য দোষ থাকিলেও সে অজন্ত৷ গুহার চিত্রাবলী সাজির ফুল ফেল । চিত্র আমাদের নিকট প্রীতি ও সম্মানের বস্তু। চিত্রের বর্ণনীয় বিষয় বাছিতে শিল্পীর কল্পনা ও আদশের পরীক্ষা হয়। যে শিল্পীর কল্পনাশক্তি যত উচ্চ, যত মৌলিক হইবে, তাহার শিল্প-আরাধনার ফল ততই উন্নত, ততই নূতনত্ব-পূর্ণ হইবে। সকল শিল্পেরই ভাব হইল প্রাণ ; রচনাপ্রণালী কেবল আকার মাত্র। রচনাপ্রণালী যতই উৎকৃষ্ট হউক না কেন, ভাবের দৈন্য থাকিলে কোন শিল্পই শ্রদ্ধেয় হয় না। - বর্ণনীয় বিষয় স্থির হইলে আকুতি বা রূপের কথা আসিয়া পড়ে, অর্থাৎ চিত্রটি কিরূপে বৰ্ণিত হইবে তাহার নিদ্ধারণ করা। এই সময় মূৰ্ত্তির গঠন ও ভঙ্গিমার বিচার করিতে হয়। ভাবটি যেমন উন্নত ও হৃদয়গ্রাহী