পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৪০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭৫৩ কাননে প্রবেশ করিলেন। পটুমহাদেবী আদিতেছেন দেখিয়া কাননরক্ষী মহল্লিকাগণ দূরে সরিয়া গেল। এক বিশালকায় প্রাচীন সহকার বৃক্ষের অন্তরালে দাড়াইয়৷ গৌড়েশ্বরী অঙ্কবালককে জিজ্ঞাস করিলেন, “বাব, শোক নাই, দুঃখ নাই, সে কোন দেশ ?” বালক কহিল, "ম, সে দেশ কোন পথে তাহ জানি না, তবে সে বলিয়াছে যে, সে দেশ আছে, সে তোমার দেশ, সে তোমার রাজ্য, দে রাজ্যের সিংহাসন শূন্ত পড়িয়া আছে, তুমি তাঁহা পূর্ণ করিবে ।" “কে বলিল, কে সে ?” "সে একজন, সে কে তাহ জানি না, তাহার রূপ রস গন্ধ নাই ; তবে সে একজন আছে মা। যে অন্ধকে পথ দেখাইয়৷ দেয়, পদে কণ্টকটি পর্য্যন্ত বিদ্ধ হইতে দেয় না, দাসের মত ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল যোগাইয় দেয়, সে সেই। তাহাকে দেখি নাই, তাহাকে স্পর্শ করি নাই, দূর হইতে শুষ্ক পত্রের মর্শ্বরধ্বনির মত তাহার বাক্য আমার-কনে আসিয় গেছে, আমি শুনিয়াছি, দেখি नाहे।” “ - “সেই কি তোমাকে পাঠাইয়া দিয়াছে ? সে কি বলিল ?” "এই মাত্র সে বলিয় গেল যে, মা তুমি গঙ্গাস্নান করিতেছ, তুমি যখন স্নান করিয়া উঠবে, তপন তোমাকে এই কথা বলিতে বলিয়া গেল ; মা ! তুমি শীঘ্ৰ তোমার দেশে যাইবে। তোমার রাজ্যে যাইবে, তাহার তোমাকে লইতে আসিবে। তোমার স্বামীর মনে ব্যথা লাগিবে, তোমার পিতার বৃদ্ধ ভূত্যের মনে ব্যথা লাগিবে, কিন্তু তুমি তাহাতে ব্যথিত হইও না। সৰ্ব্বঞ্জগতের হিতস্থথের জন্য তোমার জন্ম। তুমি কায় পরিত্যাগ করিলে, তোমার জন্মজন্মান্তরার্জিত পুণ্যফলে গৌড়দেশ উদ্ধার হইবে, গৌড়বালীর দুঃখশোকের উপশম হইবে। সে বলিয়াছে, তুমি ভয় পাইও না, তোমার পদে কুশাঙ্কুরও বিধিবে না। মা ! তুমি এদেশের নই, এ জগতের নই ; তোমার দেশ, তোমার জগত তোমার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে, এদেশে বড় দুঃখ, বড় কষ্ট, তুমি শীঘ্ৰ চলিয়া যাইবে।” "ধাইব বাপ তাহাকে জিজ্ঞাসা করিও আমি চলিয়৷ গেলে কি আমার শ্বশুরবংশের অমঙ্গল দূর হইবে ? প্রবাসী-আশ্বিন, ১৩২২ { ১৫শ ভাগ,১ম খণ্ড গৌড়রাজে আবার শাস্তি ফিরিয়া আসিবে ? গোঁড়বাসীর শোকদুঃখ বিমোচন হইবে।” - "হ'ম, সে তাহাও বলিয়াছে,-যেদিন তুমি গৌড়বাণীর জন্য আত্মোৎসর্গ করিবে, এ জগং সেইদিন শাস্ত হইবে, তোমার পুণ্যধারা অগ্নি নিৰ্ব্বাপিত হইবে। আমি যাই মা, তুমি আসিও, আমিও তোমার সঙ্গে যাইব । সে ডাকিতেছে, আমি যাই ।” অন্ধবালক নক্ষত্ৰবেগে ছুটিয়া পালাইল, কল্যাণী বৃক্ষতলে দাড়াইয়া রছিলেন, তাহার সমস্ত শরীর কম্পিত হইতে লাগিল । - এই সময়ে বিশ্বানন উন্মত্তের ন্যায় ছুটিয়া আসিয়া ঘাটের উপরে দাড়াইলেন এবং অতি ব্যস্তভাবে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন। দূরে একজন মহল্লিকা দাড়াইয়াছিল, তিনি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "তুমি এই স্থানে এক অন্ধ বালককে দেখিয়াছ ?" মহল্লিক কহিল, “কই প্রভু না।" বিশ্বানন্দ তাহাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, "কল্যাণী কোথায়?” উত্তর হইল, "পট্টমহাদেবী স্বান করিয়৷ এইমাত্র আম্রকাননে প্রবেশ করিয়াছেন।” তথন বিশ্বানন্দের আহবানে পরিচারিকা মহল্লিক ও পুরমহিলাগণ কল্যাণীর সন্ধানে ছুটিলেন। সৰ্ব্বাগ্রে বিশ্বানন্দ দেখিতে পাইলেন যে, সহকারতলে বেতগীলতার ন্যায় কম্পমান গৌড়েশ্বরী কল্যাণীদেবী দাড়াইয়া আছেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, "ম, কি হইয়াছে ?" কল্যাণী উত্তর না দিয়৷ চক্ষু মার্জন করিলেন। বিশ্বানন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, 'ম', দক্ষিণাপথ হইতে ফিরিবার সময়ে এক অন্ধ অনাথ বালককে সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিলাম, সে কি তোমার নিকট আসিয়াছিল ?” - “হ। পিতা, আসিয়াছিল।" "সৰ্ব্বনাশ, কল্যাণি । সে তোমাকে কি বলিয়া গিয়াছে ?" - "মঙ্গলসংবাদ পিত। সে বলিয়া গিয়াছে যে আমার আহবান আসিয়াছে স্বামীর মঙ্গলের জন্য, শ্বশুরকুলের মঙ্গলের জন্য, গৌড়রাজ্য ও গৌড়বাসীর শোকদুঃখ নিবারণের জন্য আমাকে যাইতে হইবে । পিতা আমি মোহমুগ্ধ, সে কোন পথ ? আমাকে পথ দেখাইয়া দিন ? ৬ষ্ঠ সংখ্যা ] - } সহস। বৃদ্ধ সন্ন্যাপী বালকের ন্যায় রোদন করিয়া উঠিলেন এবং কহিলেন, "মা, সে কোন পথ, সে কিসের পথ এবং কে আহবান করিল—এ যষ্টিবৰ্ষ বয়সেও তাহা বুঝিতে পারি নাই। তোমার রাজ্য, তোমার সিংহাসন, তোমার স্বামী, তোমার ঐশ্বধ্যসম্পদ ফেলিয়া কোথায় যাইবে মা ?" অষ্টম পরিচ্ছেদ । মণ্ডলার যুদ্ধ একপাশ্বে গঙ্গা, অপরপাশ্বে গগনস্পর্শী বিদ্ধ্যপৰ্ব্বত, মধ্য দিয়া সঙ্কীর্ণ পথ ; এই পথ মগধ ও অঙ্গ হইতে গৌড়ে আসিবার একমাত্র পথ । এই স্থাসের কিঞ্চিং পশ্চিমে পথ বিন্ধ্যের পৃষ্ঠ লঙ্ঘন করিয়া আসিয়াছে, সেইস্থানে গিরিশীর্ষে প্রস্তরনিৰ্ম্মিত ভীষণদর্শন মওলাদুর্গ অবস্থিত। লোকে বলিত দুর্গ হইতে লো? নিক্ষেপ করিলে সঙ্কীর্ণ গিরিসঙ্কটে গৌড়-আক্রমণকারী সেনার গতিরোধ করা যায়। এক দিন দিবসের প্রথম প্রহরে একজন অশ্বারোহী গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়া দুর্গের নিম্নে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং বক্র পাৰ্ব্বত্যপথ অবলম্বন করিয়া দুর্গে উঠিতে লাগিল। তোরণের রক্ষীগণ তাহার পরিচয় গ্রহণ করিয়া তোরণ মুক্ত করিল, অশ্বারোহী দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিল। সেই সময়ে উদগুপুরের মহাসামন্ত বৃদ্ধ মহানায়ক ভীষ্মদেব দুর্গপ্রাঙ্গণে উপবিষ্ট ছিলেন, অশ্বারোহী তাহাকে অভিবাদন করিয়া কহিল, “মহারাজ, রাষ্ট্রকূটসেনা কলা সন্ধ্যাগমে চম্পানগর অধিকার করিয়াছে, তাহার। অদ্য মণ্ডল আক্রমণ করিতে যাত্রা করিবে ।" ভীষ্মদেব কহিলেন, "উত্তম। নগর প্রবেশকালে কেহ বাধা দিয়াছিল কি ?” “না ; নাগরিকগণ আপনার আদেশে নগরপ্রতীহারকে বন্দী করিয়া রাখিয়াছিল,রাষ্ট্রকূটরাজ নগরে প্রবেশ করিয়া তাহাকে মুক্তি দিয়াছেন।” "রাষ্ট্রকূটসেনার সেনাপতি কে ?" "রাষ্ট্রকূটরাঙ্গ গোবিন্দ স্বয়ং এবং তাহার ভ্রাত। কক্করাজ ।” - "উত্তম ; তুমি বিশ্রাম কর।” . ক্ষণকালপরে ভীষ্মদেবের আদেশে দুর্গরক্ষী দশসহস্ৰ সেন। প্রাঙ্গণে সমবেত श्ल বৃদ্ধ মহানায়ক প্রাঙ্গণের এক ধৰ্ম্মপাল - পার্থে দাড়াইয়া উচ্চৈঃস্বরে কছিলেন, “বন্ধু মওলাদুর্গ শত্রুসেনা কর্তৃক আক্রাস্ত হইবে। দুর্গমধ্যে দশসহস্ত্রের উপযোগী সপ্তাহের মাত্র আহাৰ্য্য সঞ্চিত আছে, - সুতরাং অৰ্দ্ধাশনে থাকিলেও পঞ্চদশ দিনের অধিককাল দুৰ্গরক্ষা করা অসম্ভব। এখনও যাহারা ফিরিয়া যাইতে চাহে, তাহারা ফিরিয়া যাউক । যাহার রাষ্ট্রকূটযুদ্ধে মণ্ডল রক্ষা করিবে, তাহারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিবে না, স্বতরাং এই যুদ্ধে প্রত্যাবৰ্ত্তন নাই। এই যুদ্ধে এই গিরিসঙ্কটে গৌড়সাম্রাজ্যের ভাগ্যপরীক্ষা হইবে। যাহার প্রাণের মমতা আছে, পুনরায় আত্মীয়স্বজনের মুখ দেখিবার অভি লাষ আছে, তাহাদিগের জন্য তোরণ এখনও মুক্ত আছে; যাহারা দুৰ্গরক্ষা করিতে থাকিবে, তাহার প্রস্থত হউক। বন্ধুগণ, কল্যকার যুদ্ধে গৌড়েশ্বরের জয় হইতে পারে কিন্তু আমাদিগের প্রত্যাবৰ্ত্তন নাই ।” ੋ দশসহস্ত্রের মধ্যে একজন সেনাও উত্তর দিল না। একজন গৌড়ীয় ও একজন মাগধ সেনানীশ্রেণী হইতে অগ্রসর হইয়া মহানায়ককে অভিবাদন করিল এবং কহিল, “মহারাজ, যাহার। আপনার সহিত মণ্ডলা রক্ষা করিতে আসিয়াছে, তাহাদিগের কেহই প্রত্যাবৰ্ত্তনের আশা রাখে ন, দশসহস্ত্রের মধ্যে একজনও দুর্গ পরিত্যাগ করিবে না।” সন্ধ্যাকালে বিন্ধের পাদমূলে সহস্ৰ সহস্ৰ অগ্নিকুণ্ড জলিয়া উঠিল । রাষ্ট্রকূটসেন আসিয়াছে দেখিয়া ভীমদেব যুদ্ধের জন্য প্রস্থত হইলেন। পরদিন প্রত্যুষে স্বৰ্যোদয়ের পূৰ্ব্বে রাষ্ট্রকূটসেনা দুর্গ আক্রমণ করিল। সঙ্কীর্ণ পাৰ্ব্বত্য পথে একত্র অধিক সেনার সমাবেশ অসম্ভব, এইজন্ম দিবসের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রহরে রাষ্ট্রকূটসেনা দুর্গের দিকে অগ্রসর হইতে পারিল না। মুষ্টিমেয় গৌড়ীয় ও মাগধসেনা বারবার তাহাদিগকে পরাস্ত করিল। তখন রাষ্ট্রকূট সেনানায়কগণ গিরিসঙ্কটের চতুষ্পার্শস্থিত পৰ্ব্বতশীর্ষগুলি অধিকারের চেষ্টা করিতে লাগিলেন, সহস্ৰ সহস্র রাষ্ট্ৰকুটসেনা পৰ্ব্বতের নানাস্থান আক্রমণ করিল। ভীষ্মদেবের অধীনে দশসহঞ্জের অধিক সেনা ছিল না, তিনি গিরিসঙ্কট ও দুর্গরক্ষার জন্য দ্বিসহস্ৰ সেন রাখিয়া অবশিষ্ট পৰ্ব্বতশীর্ষসমূহে সন্নিবেশ করিয়াছিলেন। বৃহদাকার প্রস্তুরাঘাতে শত শত রাষ্ট্রকূটসেন নিহত হইল, সহস্ৰ সহস্র আহত