পাতা:প্রবাসী (পঞ্চদশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).pdf/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সেখ আন্দু - ( > ) গ্রীষ্মকালের নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহর। চারিদিক প্রচণ্ড রৌদ্রতেজে ঝ ঝ। করিতেছে। পৃথিবীর বক্ষভেদ করিয়া একটা গভীর উত্তাপ ঠেলিয়া উঠিতেছে। চারিদিকের জমাট গ্রীষ্মের গাম্ভীৰ্য্য যেন অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। ভাগলপুরের উকীল চৌধুরী-সাহেবের ইন্দ্রপুর-বিনিন্দিত কলরব-মুখর অট্টালিকা এখন সম্পূর্ণ নীরব ; গ্রীষ্মক্লিষ্ট লোকজন সকলেই যে-যাহার ঘরে বিশ্রাম করিতেছে । দ্বিতলে কৰ্ম্মনিরত দুই একজন দাসীর বিরক্তিব্যঞ্জক উচ্চ চীৎকার মাঝে মাঝে শোনা যাইতেছে। পালিত কুকুরবিড়ালগুলি, সাড়াশব্দ বন্ধ করিয়া, স্থানে স্থানে পড়িয়া, অকাতরে নিদ্র। যাইতেছে। কুঠার বামদিকের সীমানায় চাকরদের একতলা গৃহশ্রেণী। চাকরের ছুটি পাইয়া সকলেই গৃহদ্বার ঠেসাইয়া শুইয়া পড়িয়াছে। ঘরগুলি সবই উত্তরদ্ধারী, কাজেই বারান্দায় রৌদ্র না পড়িলেও ঘরগুলা রৌদ্রতাপে অতিশয় গরম হইয়া উঠিয়াছে। - বারান্দার প্রান্তে টুলের উপর সেলাইয়ের কল রাখিয়৷ একটা ছোট চৌকীতে বসিয়া গায়ে তোয়ালে জড়াইয়া চৌধুরীসাহেবের মোটরগাড়ীচালক তরুণ যুব আন্দু মিঞা কতকগুলি কাপড়ে লেশ, বসাইতেছিল। পাশে বেঞ্চির উপর কয়েকটা লেশের পাকানো বাণ্ডিল ও কতকগুলা নূতন কাপড় ভাজ করা রহিয়াছে। আন্দুর দৈহিক গঠন পৌরুষ-কঠিন,–কিন্তু ললিতাবর্জিত নয়। প্রশস্ত ললাটে মমতা শীলতার চিহ্ন ফুটিয়৷ উঠিতেছে, চক্ষু দুটি নম্র স্নিগ্ধ, বিশাল বক্ষ, আজানুলম্বিত বাহু, সৰ্ব্বশরীর পেশীসবল, পুষ্টমুন্দর, মনোরম লাবণ্যে উদ্ভাসিত। অবিশ্রাম কলের শব্দের সহিত যুবা একমনে সেলাই করিতেছে। অনেকক্ষণ কাটিল। মধ্যাহ্নের পরতপ্ত বাতাস মাঝে মাঝে আগুনের হস্ক ছড়াইয়া, হু-হু করিয়া বহিয়া যাইতেছে। কপালের উপর অবিন্যস্ত রেশমের মত কোমল মসৃণ কেশরাশি ঘামে ভিজিয়া উঠিল, টসটস করিয়া প্রবাসী—বৈশাখ, >૭૨૨ [ ১৫শ ভাগ, ১ম খণ্ড ঘাম ঝরিল । যুবা তোয়ালে খুলিয়া, সৰ্ব্ব শরীরের ঘাম মুছি। তোয়ালে আবার কাধে ফেলিল। গ্রীষ্ম-ভারাক্রান্ত নিঃশ্বাস ছাড়িয়া মাথা তুলিয়া একবার রৌদ্রঝলসিত বহিপ্রকৃতির পানে দৃষ্টিপাত করিয়া আবার সেলাই আরম্ভ করিল। পাশের দ্বার খুলিয়া সুপ্তিরক্ত চক্ষু মুছিতে মুছিতে অশ্বচালক আকবর আসিয়া পাশের চৌকীতে বসিল । বারম্বার চক্ষু মুদিয়া বাহিরের আলোটা চোখে ভাল করিয়া সহাইয়৷ লইয়া সশব্দে কণ্ঠের শ্লেষ্মা দূর করিয়া বিরক্ত স্বরে বলিল— ইস গরমের চোটে জান জখম হয়ে উঠছে, এ সময় কলের থ্যাচ থ্যাচানি আওয়াজ !—তোমার এসব ভালও তে৷ লাগে বাপু ! উঃ ভারি অসহ ।” কলের স্থচের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া মুছ হাস্তে আৰু বলিল, “শুয়ে শুয়ে ছটফট করার চেয়ে একটা কাজে জোড়া থাকা মন্দ কি ৷” আকবর সে কথার জবাব না দিয়া বলিল, "এসব হচ্ছে কি ?” - “দরজা জানলার পদার হাতে-বোন স্থতোর লেশ, বসান হচ্ছে ।” - “বরাং কার ? ফরমাস দিলে কে ?” “খুকুমণি।” "হু ! তোমার যেমন থেয়ে দেয়ে কাজ নেই, তাই বাজে কাজের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে অনর্থক ভূতের ব্যাগার থেটে মরছ,—তুমি-সাহেব তাই পার, আমি হলে ঠিক স্থাকিয়ে দিতুম, সে দাদাই হোক আর দিদিই হোক " আকবরের বীরত্বগৰ্ব্বিত উক্তির উত্তরে আন্দু কিছু বলিল না, শুধু একটু হাসিল। আন্দু অন্য কথা পাড়িল । উভয়ে বসিয়া কথা কহিতেছে, এমন সময় চোধুরীসাহেবের সপ্তদশ বর্ষীয়া তনয়। লতিকাদেবী বারান্দায় আসিয়া দেখা দিল । লতিক অবিবাহিত , কলিকাতায় বোর্ডিঙে থাকিয়া পড়াশুনা করে, এবারে এন্টান্স পরীক্ষা দিয়া গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ী আসিয়াছে । লতিকার চেহারা মোটের উপর মন্দ নয়। তবে অস্বাভাবিক অহঙ্কারের আবরণে আপাদমস্তক আবৃত থাকায় তাহার রমণী-সুলভ সুকোমল সৌন্দর্য্য-শ্রীর উপর একটা উগ্ৰত আসিয়া পড়িয়াছে। লতিকার বেশভূষা পরিচ্ছন্ন মার্জিত, শুভ্র স্বন্দর । লতিকার হাতে একটা ফুটন্ত গোলাপ ফুল ; সেটাকে উঁচু করিয়া ধরিয়া, তাচ্ছিল্য দৃষ্টিতে এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে, আসিয়া তাহাদের ঠিক সম্মুখে দাড়াইল । স্থানট। এসেন্সের তীব্র মধুর সৌরভে আমোদিত হইয়া উঠিল। লতিকার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আন্দুর মাথা অনাবশ্বকরূপে খুব বেশ ঝুকিয় পড়িয়া কলের অঙ্গপ্রত্যঙ্গসকল উদ্বিগ্ন দৃষ্টতে পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল। স্বভাব-সিদ্ধ চঞ্চল কটাক্ষে চারিদিকে চাহিয়া লইয়া লতিক যথাসাধ্য গষ্ঠীর মুখে বলিল "বাঃ! তুমি ত দর্জির কাজ বেশ জান দেখছি। এ কলটা কার ? তোমার ?" আন্দু বিনীত ভাবে বলিল, “আজে হ্য।” “তোমার আগে দর্জির দোকান ছিল না ?” “আজ্ঞে আমার বাবার ছিল ।” আকবরের দিকে ফিরিয়া লতিকা বলিল—“আকবর, তোমার ছেলেদের দেশে পাঠিয়েছ অনেকদিন, আর আন না কেন ? কেমন আছে তারা সব ?” আকবরের ছেলেদের জন্য লতিকার যে খুব গুরুতর আগ্রহ আছে, তাহার প্রশ্নের ভঙ্গীতে এমন কোন দুলক্ষণ প্রকাশ পাইল না। আকবর একটু সরিয়া বসিয়া বলিল, "তাদের সব অস্বথ করেছে।” “অস্থখ করেছে ? ও: ! কি অস্থখ ?” আকবরের মুখপানে চাহিয়া কথা কয়টি জিজ্ঞাসা করিয়াই তাহার উত্তর শুনিবার অবকাশ হইল না, লতিক আব্দুর দিকে চাঁহিয়া হঠাং জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, তুমি দোকান ছাড়লে কেন ?" আন্দু একটু হাসিল, বলিল—“সে নান। কারণে তুলে দিয়েছি।” "তোমার কলটা বেশ ভাল, সরসী এটা কিনব বলছিল। আচ্ছ। এ কাপড়গুলো কার ? তারি কি ?" "আঞ্জে হ্য।” "উ কি গরম !" বলিয়৷ দুইহাতের মধ্যে সজোরে মুখটা খসিয়া বঁ হাতের চুড়িগুলি লতিকা নাড়িয়া দেখিতে লাগিল। সে এৰার কলিকাতা হইতে পছন্দ করিয়া রং মিলাইয়৷ এক হাত কাচের সরু সরু চুড়ি পরিয়া আসিয়াছে। চুড়ি দেখিতে দেখিতে মুখ তুলিয়া আকবরকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কখনো কলকাতা গিছলে ?” সেখ আন্দু 〉8○ SumitaBot (আলাপ) ০৮:০০, ১৯ এপ্রিল ২০১৬ (ইউটিসি) আকবর বলিল "না।” "কলকাতা বেশ জায়গা, ভাগলপুরট অতি বিচ্ছারি গরম দেশ।”—কলিকাতার তুলনায় ভাগলপুর অত্যন্ত দুঃসহ হতশ্ৰী অনুভব করিয়া লতিকা বিরক্ত হইল। অতিশয় অস্থিরভাবে বারান্দার প্রাস্তাবধি এক চক্র ঘুরিয়া আসিয়া তাহার পর আবার সেইখানে দাড়াইল। প্রশংসমান দৃষ্টিতে চাহিয়া চাহিয়া কলের কাজ দেখিতে লাগিল। হাতের ফুলটার পাপড়ি ছিড়িতে ছিড়িতে বলিল, "আচ্ছা তুমি কতক্ষণে এগুলো সেলাই কৰ্ত্তে পার ?” আন্দু আনত দৃষ্টিতে বলিল, “ঘণ্টা দেড়েকের বেশী সময় লাগবে না বোধ হয়।” ঠিক এই সময় বিলাতী বুটের মশমশানি শব্দে চারিদিক মুখর হইয়া উঠিল। দুপ দাপ শব্দে সিড়ি ভাঙ্গিয়া চৌধুরীসাহেবের ভ্রাতুপুত্র কিরণচন্দ্র বারান্দায় উঠিলেন। কলেজে পড়াশুনার কিছু গোলযোগ হওয়ায় সেখানে কিঞ্চিং ও তা খাইয়া বেচারীর মেজাজ সেদিন নিতান্তই বিগড়াইয়া গিয়াছিল। বারান্দায় উঠিয়াই নিশ্চিন্তু উপবিষ্ট আকবরকে দেখিয়া উগ্রস্বরে বলিল, “নবাব সাহেব, নতুন ঘোড়াকে টহল দেওয়া হয়েছে ? না বয়ে গেছে ?" কিরণের অকারণ উগ্রতায় আকবরও অকস্মাং চটিল ; সেও সমান স্বরে গলা চড়াইয়া জবাব দিল—“না।” আর যায় কোথা ! গু তার উপর বিষম হচট অপমানিত কিরণচন্দ্র রুখিয়া দাড়াইয়া আকবরের উদ্দেশে সোজা বাক্যের উৎস খুলিয়া দিল। কলেজের ছাত্র কিরণের যুবক-জীবন যে মলয়ের বাতাস জ্যোৎস্নার আলো আর ফুলের গন্ধে ভরপুর ছিল না, তাহা অনেকে জানিত— সৰ্ব্বাপেক্ষা ভাল জানিত, চাকরেরা ; আজ সে আহতচক্র ভূজঙ্গের ন্যায় তাহার প্রচণ্ড প্রমাণ বর্ষণ করিয়া আকবরকে পরিষ্কাররূপে বুঝাইয়া দিল—সে যে-ণে লোক নহে। রুক্ষস্বভাব পুরাতন চাকর আকবরও চুপ করিয়া সহিবার পাত্র নহে, সে ও সুস্পষ্টরূপে জানাইয়া দিল এত রৌদ্রে ঘোড়া ঘুরাইয়া আনা তাহার কৰ্ম্ম নহে। - - কিরণচন্দ্র চাকরদের কাজে প্রয়োজনের অতিরিক্ত দৃষ্টি রাখিত বলিয়া কেহই তাহাকে প্রসন্ন চক্ষে দেখিতে পাৱিত না। কিন্তু হইলে কি হয় ? পিতৃব্যের অনর্থক অপব্যয়,