পাতা:প্রবাসী (সপ্তবিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড).djvu/৩৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩য় সংখ্যা ] সত্তর বৎসর "G8ථ স্বাধীনতা ভোগ করিতেন। অবরোধ-প্রথা ত ছিলই না, বরঞ্চ মণিপুরী মহিলার, আজকাল যাহাকে ইংরেজীতে ইকনমিক ফ্রীডমু কিংবা আর্থিক স্বাধীনতা কহে, ইহাও ভোগ করিতেন। ইছারা নিজেদের স্বামীর বা পুত্রের কিংবা পরিবারের অন্যান্য পুরুষদিগের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। বরঞ্চ এমনও শোনা যাইত যে, মণিপুরে মহিলারাই পরিবারের ভরণ-পোষণ করিতেন, পুরুষেরা এক-প্রকার নিজনিজ পরিবারের অন্নদাস হইয়াই থাকিতেন। শ্রীহট্টের মণিপুরী সমাজেs ইহার কতকটা প্রমাণ পাইতাম। অন্তত: কোন মণিপুরী স্ত্রীলোক যে কেবল ঘরে থাকিয়াই গৃহকৰ্ম্মে ব্যস্ত থাকিতেন, অর্থোপার্জনে স্বামীর সহায় ছিলেন না, এমন দেখি নাই। মণিপুরী স্ত্রীলোকের ঘরে যেমন গৃহকৰ্ম্ম করিতেন, সেইরূপ নিজেদের অথবা পরিবারের পুরুষদিগের তৈয়ারী পণ্য মাথায় করিয়া বাজারে বিক্ৰী করিতেন। সন্তানবতী জননীরাও মাথায় মোট ও পিঠে কাপড় দিয়া নিজেদের দুগ্ধ-পোষ্য শিশুকে বধিয়া বাড়ী বাড়ী জিনিষ ফিরি করিয়া বেড়াইতেন। শ্ৰীহট্টের মণিপুরী “খেল” ঐ অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিল। মণিপুরীরা সস্তা মশারীও বুনিতেন। ইহা ছাড়া কাঠের কাজে ইহাদের অসাধারণ দক্ষত ছিল। সহরের চেয়ার টেবিল ইহারাই জোগাইতেন। বাশ এবং বেত দিয়া মোড়া,পেটি প্রভৃতিও মণিপুরীরাই প্রস্তুত করিতেন। এই সকল শিল্পে ইহার অসাধারণ নিপুণভা লাভ করিয়াছিলেন। ঐহটে রথ-যাত্রার দিন খুব সমারোহ হইত। শ্ৰীকৃষ্ণের রথযাত্রা মণিপুীদিগের একটা বিশেষ পৰ্ব্ব ছিল। প্রায় প্রত্যেক সম্পন্ন মণিপুরী গৃহস্থের বাড়ী হইতেই এক এক থান রথ রাজপথে বাহির হইত। এমন হান্ধ, এমন সুক্ষর সজ্জিত, এমন রসকলার নিদর্শন বোধ হয় ভারতের অন্য কোন প্রদেশের রথে দেখা যায় না। মণিপুরীর বঁাশ দিয়া এই রথ নিৰ্মাণ করিতেন। চাকাও বঁশেরই হইত কি না মনে পড়ে না । ইহা অসম্ভব হইলে, এসকল রথের চাকাতেই কেবল যা কিছু কাঠ থাকিত, আর সবই বঁাশের ছিল। রথের ঠাট বঁশের, কিন্তু তাহার আস্তরণ পাতার । কঁাটাল পাতা দিয়াই অধিকাংশ স্থলে রথের চালা ও বেড়া গাঁথা হইত। আর কচি আমের পল্লব কিংবা বকুলের ডালে মাঝে মাঝে চাপা ও অন্ত সুগন্ধ ফুল গাঁথিয় রথ সাজান হইত। চন্দনচর্চিত দেহে, গুলঞ্চের মালা পরিয়া মণিপুরীরা যখন হরিধ্বনি করিয়া, খোল কৰ্ত্তাল সঙ্গে কীৰ্ত্তন গাহিয়া সারি সারি রথ রাজপথে টানিয়া লইয়। যাইতেন, তখন সহরের এক আশ্চৰ্য্য শোভা হইত। এসকল রথ এমন হাল্কা বলিয়া যে ভারসহ ছিল না এরূপ নহে। এই রথের উপরেই মাহুষ চড়িয়া কলা, আনারস প্রভৃতির হরির লুঠ দিতে দিতে যাইতেন। কিন্তু মণিপুরী রাস শ্ৰীহট্টের মণিপুরী সমাজে সৰ্ব্বপ্রধান উৎসব ছিল । এ রাস এক অপূৰ্ব্ব দৃশ্ব ছিল। মণিপুরীরা অত্যন্ত-সঙ্গীত-রসজ্ঞ এবং সঙ্গীতরসলিপ । সঙ্গীতের চর্চা ঘরে ঘরে । মহিলারা প্রায় সকলেই নৃত্যগীত শিথিয়া থাকেন। এই রাসযাত্রায় ইহারা বাংলা দেশের মত্তন মূৰ্ত্তি রচনা করেন না। নিজের রাসলীলার অভিনয় করিয়া থাকেন। কোন সম্পন্ন গৃহস্থের প্রাঙ্গণে বা নাট মন্দিরে পল্লীর সকল বালক-বালিকা মিলিয়া এই অভিনয় করেন। বৃত্তাকারে মুসজ্জিত বালকবালিকার প্রাঙ্গণটা ঘেরিয়া দাড়াইয়া যান। আট নয় বছরের বালক বালিকা হইতে আঠার বছরের অনুঢ়া যুবতী পর্য্যস্ত এই অভিনয়ে সামিল হইয়া থাকেন। বৃত্ত্বের বাহিরে ইহাদের পিতামাতা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রভৃতি গুরুজনের মিলিয়া খোল কৰ্ত্তাল সহকারে রাসলীলা কীৰ্ত্তন করেন, আর ইহাদের বালক-বালিকার হাতে হাতে ধরিং, ঘুরিয়া ঘুরিয়া, অতি মৃদুমধুর নৃত্যকলা সহকারে এই লীলার অভিনয় করেন। যার রাসে নাচে তাহদের একটি করিয়া কৃষ্ণ সাজে ও তাহার দ্ব পাশে দুইটি করিয়া রাধা সাজিয়া থাকে। দেশে বিদেশে অনেক নাচ দেখিয়াছি কিন্তু এই মণিপুরী নাচের মতন এমন সুন্দর, এমন নিৰ্ম্মল, এমন নিপুণ মৃত্যকলা কোথাও দেখি নাই। আমার বাল্যকালে কাৰ্ত্তিক আগ্রহায়ণ মাসে গ্ৰীকৃষ্ণের রাসযাত্রার সময়ে এই জীবন্ত মণিপুরী রাস দেখিবার জন্য সহরের লোক ভাঙ্গি পড়িত।