পাতা:বঙ্কিম রচনাবলী (প্রথম খণ্ড).pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চন্দ্রশেখর রামচরণ আসিয়া দেখিল,—লোকে শনিয়া বিস্মিত হইবে—শৈবলিনী নিদ্রা যাইতেছেন। এ অবস্থায় নিদ্রা সমভাবে না। সম্পভাবে কি না, তাহা আমি জানি না, –আমরা যেমন ঘটিয়াছে তেমনি লিখিতেছি। রামচরণ শৈবলিনীকে জাগরিতা না করিয়া প্ৰতাপের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিল, “তিনি ঘামাইতেছেন—ঘম ভাঙ্গাইব কি ?” শনিয়া প্ৰতাপ বিস্মিত হইল— মনে মনে বলিল, চাণক্য পন্ডিত লিখিতে ভুলিয়াছেন; নিদ্রা সত্ৰীলোকের ষোল গণ! প্রকাশ্যে বলিলেন, “এত পীড়াপীড়িতে প্রয়োজন নাই। তুমিও ঘৰমাও—পরিশ্রমের একশেষ হইয়াছে। আমিও এখন একটা বিশ্রাম করিব।” রামচরণ বিশ্রাম করিতে গেল। তখনও কিছ রাত্রি আছে। গহ-গহের বাহিরে নগরী —সব্বত্র শব্দহীন, অন্ধকার। প্ৰতাপ একাকী নিঃশব্দে উপরে উঠিলেন। আপন শয়নকক্ষাভিমখে চলিলেন। তথায় উপনীত হইয়া দেবার মক্ত করিলেন—দেখিলেন, পালঙেক শয়ানা শৈবলিনী। রামচরণ বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিল যে, প্রতাপের শয্যাগহেই সে শৈবলিনীকে রাখিয়া আসিয়াছে। । প্ৰতাপ জবালিত প্ৰদীপালোকে দেখিলেন যে, শোিবত শয্যার উপর কে নিৰ্ম্মল প্রস্ফটিত কুসােমরাশি ঢালিয়া রাখিয়াছে। যেন বর্ষাকালে গঙগার সিথর শেবত-বারি বিস্তারের উপর কে প্রফতুল্ল-শৈবত-পদ্ম-রাশি ভাসাইয়া দিয়াছে। মনোমোহিনী স্থির শোভা ! দেখিয়া প্রতাপ সহসা চক্ষ, ফিবাইতে পারিলেন না। সৌন্দয্যে মগধ হইয়া, বা ইন্দ্ৰিয়-বশ্যতা প্রযক্ত যে, তাহার চক্ষ ফিরিল না। এমত নহে!—কেবল অন্যমন বশতঃ তিনি বিম গোধর ন্যায় চাহিয়া রহিলেন। অনেক দিনের কথা তাঁহার মনে পড়িল—অকস্মাৎ সমাতি-সাগর মথিত হইয়া তরঙ্গের উপর তরঙগ প্ৰহত হইতে লাগিল । শৈবলিনী নিদ্রা যান নাই—চক্ষ মদিয়া আপনার অবস্থা চিন্তা করিতেছিলেন। চক্ষ নিমৰীলিত দেখিয়া, রামচরণ সিদ্ধান্ত করিয়াছিল যে, শৈবলিনী নিদ্রিতা। গাঢ় চিন্তাবশতঃ প্রতাপের প্রথম প্রবেশের পদধবনি শৈবলিনী শনিতে পান নাই। প্রতাপ বন্দকটি হাতে করিয়া উপরে আসিয়াছিলেন। এখন বন্দকটি দেয়ালে ঠেস দিয়া রাখিলেন। কিছ, অন্যামনা হইয়াছিলেন—সাবধানে বন্দকটি রাখা হয় নাই; বন্দকটি রাখিতে পড়িয়া গেল। সেই শব্দে শৈবলিনী চক্ষ চাহিলেন—প্ৰতাপকে দেখিতে পাইলেন। শৈবলিনী চক্ষ মাছিয়া উঠিয়া বসিলেন। তখন শৈবলিনী উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “এ কি এ ? কে তুমি ?” এই বলিয়া শৈবলিনী পালতেক মচ্ছি তা হইয়া পড়িলেন। প্রতাপ জল আনিয়া, মচ্ছিত শৈবলিনীর মখমন্ডলে সিঞ্চন করিতে লাগিলেন-সে। মািখ শিশির-নিষিক্ত-পদ্মের মত শোভা পাইতে লাগিল। জল, কেশগচ্ছ সকল আদ্র করিয়া, * সকল ঋজ করিয়া, ঝরিতে লাগিল—কেশ, পদ্মাবলম্বী শৈবাল্যাবৎ শোভা পাইতে ‘ळ । অচিরাং শৈবলিনী সংজ্ঞাপ্ৰাপত হইল। প্রতাপ দাঁড়াইলেন। শৈবলিনী সিথরভাবে বলিলেন, “কে তুমি ? প্রতাপ ? না, কোন দেবতা ছলনা করিতে আসিয়াছ ?” প্ৰতাপ বলিলেন, “আমি প্ৰতাপ।" শৈ। একবার নৌকায় বোধ হইয়াছিল, যেন তোমার কন্ঠ কাণে প্রবেশ করিল। কিন্তু তখনই বঝিলাম যে, সে ভ্রান্তি। আমি স্বপন দেখিতে দেখিতে জাগিয়াছিলাম, সেই কারণে ভ্ৰান্তি মনে করিলাম। এই বলিয়া দীঘ নিশবাস ত্যাগ করিয়া শৈবলিনী নীরব হইয়া রহিলেন। শৈবলিনী সম্পর্ণেরপে সস্থিরা হইয়াছেন দেখিয়া প্ৰতাপ বিনাবাক্যব্যয়ে গমনোদ্যত হইলেন। শৈবলিনী বলিলেন, “যাইও না।” প্ৰতাপ অনিচ্ছাপাকবািক দাঁড়াইলেন। শৈবলিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এখানে কেন আসিয়াছ ?” প্রতাপ বলিলেন, “আমার এই বাসা।" শৈবলিনী বস্তুতঃ সস্থিরা হন নাই। হৃদয়মধ্যে অগিন জীবলিতেছিল—তাঁহার নখ পৰ্য্যন্ত কাঁপিতেছিল—সব্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হইয়াছিল। তিনি, আর একটি নীরব থাকিয়া, ধৈৰ্য্য সংগ্ৰহ করিয়া পনরাপি বলিলেন, “আমাকে এখানে কে আনিল ?” 8 N \O