পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চন্দ্রশেখর আসিলাম ? না ?” শৈবলিনী আপনার কপালে করাঘাত করিয়া অশ্রবর্ষণ করিতে লাগিল। বেদগমের সেই গৃহ মনে পড়িল । যেখানে প্রাচীর-পাশ্বে শৈবলিনী স্বহস্তে করবীরবৃক্ষ রোপণ করিয়াছিল—সেই করবীরের সৰ্ব্বোচ্চ শাখা প্রাচীর অতিক্রম করিয়া, রক্তপুষ্প ধারণ করিয়া, নীলাকাশকে আকাঙ্ক্ষা করিয়৷ দুলিত, কখনও তাহাতে ভ্রমর বা ক্ষুদ্র পক্ষী আসিয়া বসিত, তাহা মনে পড়িল । তুলসীমঞ্চ—তাহার চারিপাশ্বে পরিষ্কৃত সুমার্জিত ভূমি, গৃহপালিত মার্জার, পিঞ্জরে ফুটবাক পক্ষী, গৃহপাশ্বে সুস্বাদু আমের উচ্চ বৃক্ষ —সকল স্মরণপটে চিত্রিত হইতে লাগিল । কত কি মনে পড়িল ! কত সুন্দর স্বনীল,মেঘশূন্ত আকাশ শৈবলিনী ছাদে বসিয়া দেখিতেন ; কত স্বগন্ধ প্রস্ফুটিত ধবলকুসুম পরিষ্কার জলসিক্ত করি , চন্দ্রশেখরের পূজার জন্য পুষ্পপাত্র ভরিয়া দিতেন ; কত স্নিগ্ধ, মন্দ, সুগন্ধি বায়ু ভীমতটে সেবন করিতেন ; জলে কত ক্ষুদ্র তরঙ্গে স্ফটিকবিক্ষেপ দেখিতেন : তাতার তীরে কত কোকিল ডাকিত । শৈবলিনী আবার নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া ভাবিতে লাগিলেন, "মনে করিয়াছিলাম, গৃহের বাহির হইলেই প্রতাপকে দেখিব ; মনে করিয়াছিলাম, আবার পুরন্দরপুরের কুঠতে ফিরিয়া সাইব-প্রতাপের গৃহ এবং পুরন্দরপুর নিকট ; কুঠীর বাতায়নে বসিয়৷ কটাক্ষজাল পতিয় প্রতাপ-পক্ষীকে ধরিব, সুবিধা বুঝিলে সেখান হইতে ফিরিঙ্গীকে ফাকি দিয়া পলাইয়! যাইব, গিয়া প্রতাপের পদতলে লুটইয়া পড়িল । আমি পিঞ্জরের পাখী, সংসারের গতি কিছুই জানিতাম না । জানিতাম না যে, মঙ্গুষ্যে গড়ে, বিধাতা ভাঙ্গে ; জানিতাম না যে, ইংরেজের পিঞ্জর লোহার পিঞ্জর—আমার সাধ্য কি ভাঙ্গি । অনর্থক কলঙ্ক কিনিলাম, জাতি কারাইলাম, পরকাল নষ্ট করিলাম।” পাপিষ্ঠ। শৈবলিনীর এ কথা মনে পড়িল না যে, পাপের অনর্থকতা আর সার্থকতা কি ? বরং অনর্থকতাই ভাল । কিন্তু এক দিন সে এ কথা বুঝিবে, এক দিন প্রায়শ্চিত্ত জন্য সে অস্থি পৰ্য্যস্ত সমর্পণ করিতে প্রস্তুত হুইবে । সে আশা না থাকিলে আমরা এ পাপচিত্রের অবতারণা করিতাম না। পরে সে ভাবিতে লাগিল, “পরকাল ? সে ৩ যে দিন প্রতাপকে দেখিয়াছি, সেই দিন গিয়াছে । যিনি অন্তৰ্য্যামী, তিনি সেই দিনই আমার কপালে নরক লিখিয়াছেন । ইহকালেও আমার নরক হইযুছে-আমার মনই নরক—নহিলে এত দুঃখ কেন সুন্দরীর সঙ্গে ফিরিলাম ২৯ পাইলাম কেন ? নহিলে দুই চক্ষের বিষ ফিরিঙ্গীর . সঙ্গে এত কাল বেড়াইলাম কেন ? শুধু কি তাই ! বোধ হয়, যাহা কিছু আমার ভাল, তাহাতেই অগ্নি লাগে, বোধ হয়, আমার জন্য প্রতাপ এই বিপদগ্ৰস্ত হইয়াছে—আমি কেন মরিলাম না ?” শৈবলিনী আবার কঁাদিতে লাগিল। ক্ষণেক পরে চক্ষু মুছিল ; ভ্র কুঞ্চিত করিল ; অধর দংশন করিল ; ক্ষণকাল জন্য তাহার প্রফুল্ল রাজীবভুল্য মুখ রুষ্ট সপের চক্রের ভীমকাস্তি শোভা ধারণ করিল । সে আবার বলিল, “মরিলাম না কেন ?" শৈবলিনী সহসা কটি হইতে একটি গেজে' বাহির করিল। তন্মধ্যে তীক্ষুধার ক্ষুদ্র ছুরিকা ছিল । শৈবলিনী ছুরিক। গ্রহণ করিল। তাহার ফলক নিস্কোষিত করিয়া অঙ্গুষ্ঠের দ্বারা তৎসহিত ক্রীড়া করিতে লাগিল । বলিল, “বৃথা কি এ ছুরি গ্রহণ করিয়াছিলাম ? কেন এত দিন এ ছুরি আমার এ পোড়া বুকে বসাই নাই ? কেন,— কেবল আশায় মজিয়া । এখন ?” এই বলিয়া শৈবলিনী ছুরিকাগ্রভাগ হৃদয়ে স্থাপিত করিল। ছুরি সেই ভাবে রহিল । শৈবলিনী ভাবিতে লাগিল, “আর এক দিন ছুরি এইরূপে নিদ্রিত ফষ্টরের বুকের উপর ধরিয়াছিলাম ; সে দিন তাঙ্গাকে মারি নাই ; সাহস হয় নাই ; আজিও আত্মহত্যায় সাহস হইতেছে না । এই ছুরির ভয়ে তুরস্তু ইংরেজ ও বশ হইয়াছিল,—সে বঝিয়াছিল যে, সে আমার কামরায় প্রবেশ করিলে, এই ছুরিতে হয় সে মরিবে, নয় আমি মরিব । দুরন্ত ইংরেজ ইহার ভয়ে বশ হইয়াছিল,—আমার এ দুরস্ত হৃদয় ইহার ভয়ে বশ হইল না । মরিব ? না, আজ নহে ৷ মরি ত সেই বেদগ্রামে গিয়া মরিব । সুন্দরীকে বলিব যে, আমার জাতি নাই, কুল নাই, কিন্তু এক পাপে আমি পাপিষ্ঠ নহি । তার পর মরিব —আর তিনি—আর যিনি আমার স্বামী— তাহাকে কি বলিয়া মরিব ? কথা ত মনে করিতে পারি না । মনে করিলে বোধ হয়, আমাকে শতসহস্র বৃশ্চিকে দংশন করে—শিরায় শিরায় আগুন জ্বলে । আমি তাহার যোগ্য নহি বলিয়া, আমি তাহাকে ত্যাগ করিয়া আসিয়াছি । তাতে কি তার কোন ক্লেশ হইয়াছে ? তিনি কি দুঃখ করিয়াছেন ? না,— আমি তাহার কেহ নহি । পুতিই তাহার সব । তিনি আমার জন্য দুঃখ করিবেন না । একবার নিতান্ত সাধ হয়, সেই কথাটি আমাকে কেহ আসিয়া বলে—তিনি কেমন আছেন, কি করিতেছেন। র্তাহাকে আমি কখনও ভালবাসি নাই—কখনও ভালবাসিতে পারিব না—তথাপি তাহার মনে যদি