পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (তৃতীয় ভাগ).djvu/১২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চন্দ্রশেখর “তবে কেন ঐ নৌকায় আমাদের উঠাইয়া দাও না । তোমাকে অনেক টাকা দিব ।” ফ। আমি তাহ পারিব না । উহারা আমার নৌকা ধরিতে পারিলে আমাকে মারিয়া ফেলিবে । দ । আমি বারণ করিব । ফ। তোমার কথা শুনিবে না । তোমাদের দেশের লোক স্ত্রীলোকের কথা গ্রাহ করে না । দলনী তখন ব্যাকুলত বশতঃ জ্ঞান হারাইলভাল মন্দ ভাবিয়া দেখিল না । যদি ইহা নিজামতের নেীক না হয়, তবে কি হইবে, তাহ ভাবিল না । এ নৌকা ষে নিজামতের নহে, সে কথ। তাহীর মনে আসিল না। ব্যাকুলতা বশতঃ আপনাকে বিপদে নিক্ষেপ করিল, বলিল, “তবে আমাদের তীরে নামাইয় দিয়া তুমি চলিয়। যাও ।” সষ্টর সানন্দে সন্মত হুইল । লগাইতে হুকুম দিল । কুল্‌সমৃ বলিল, “আমি নামিব না । আমি নবাবের হাতে পড়িল অমর কপালে কি আছে, বলিতে পারি না । আমি সাহেবের সঙ্গে কলিকাতায় যাইব--সেখানে তামার জান শুন লোক আছে ।" দলনা বলিল, “তোর কোন চিন্তা নাই । যদি তামি বঁচি, তবে তোকেও বাচাইব ।” - কুল্‌দম্‌। তুমি বাঢ়িলে ত ? কুলসমৃ কিছুতেই নামিতে রাজি হইল ন৷ দলনী তাহাকে অনেক বিনয় করিল –সে কিছুতেই শুনিল ন] | ফষ্টর কুলুসকে বলিল, “কি জানি, যদি তোমার জন্ম নৌক৷ পিছু পিছু আইসে । তুমিও মাম " কুল্‌সমৃ বলিল, “যদি আমাকে ছাড়, তবে আমি ঐ নৌকায় উঠিয়া, সাহাতে নৌকাওয়ালার তোমার সঙ্গ ন ছাড়ে, তাহাই করিব ।” -- ফষ্টর ভয় পাইয়। আর কিছু বলিল না—দলনী কুলুসমের জন্য চক্ষের জল ফেলিয়। নৌকা হইতে উঠিল। ফষ্টর নৌক খুলিয়। ঢলিয়া গেল। তখন সূৰ্য্যাস্তের অল্পমাত্র বিলম্ব আছে । ফষ্টরের নৌক ক্রমে দৃষ্টির বাহির হইল, যে ক্ষুদ্র তরণকে নিজামতের নৌক ভাবিয়া ফষ্টর দলনীকে নামাইয়া দিয়াছিল, সে নৌকাও নিকটে আসিল । প্রতিক্ষণে দলনী মনে করিতে লাগিল যে, নৌকা এইবার তাহাকে তুলিয়া লইবার জন্য ভিড়িবে, কিন্তু নৌকা ভিড়িল না। তখন তাহাকে দেখিতে পাইয়াছে কি না, এই সন্দেহে দলনী অঞ্চল উৰ্দ্ধোখিত করিয়া আন্দোলিত করিতে লাগিল । তথাপি নৌকা ফিরিল নৌক। তীরে (t○ ন! ; বাহিয়া বাহির হইয়া গেল । তখন বিত্যচমকের ন্তায় দলনীর চমক হইল—এ নৌকা নিজামতের কিসে সিদ্ধান্ত করিলাম ! অপরের নৌকা হইতেও পারে । দলনী তখন ক্ষিপ্তার ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে সেই নৌকার নাবিকদিগকে ডাকিতে লাগিল। “এ নৌকায় হইবে না” বলিয়া তাহারা চলিয়। গেল । দলনীর মাথায় বজ্রাঘাত পড়িল। ফক্টরের নৌকা তখন দৃষ্টির অতীত হইয়াছিল—তথাপি সে কুলে কুলে দৌড়িল, তাহা ধরিতে পরিবে বলিয়। দলনী কুলে কুলে দৌড়িল । কিন্তু বহুদূরে দৌড়িয় নৌকা ধরিতে পারিল না। পূর্বেই সন্ধ্য হইয়াছিল--এক্ষণে অন্ধকার হইল । গঙ্গার উপরে আর কিছু দেখা যায় না। অন্ধকারে কেবল বর্মীর নববারিপ্রবাহের কলকলধ্বনি শুনা যাইতে লাগিল। তখন হতাশ হইয়। দলনী উন্মুলিত ক্ষুদ বৃক্ষের ন্যায় বসিয়। পড়িল ! ক্ষণকাল পরে দলনী আর গঙ্গাগৰ্ভ মধ্যে বসিয়া কোন ফল নাই বিবেচনা করিয়া গাত্রোথান করিয়া, ধীরে ধীরে উপরে উঠিল । অন্ধকারে উঠিবার পথ দেখা যায় না । দুই একবার পড়িয়া উঠিল । উঠিয়া ক্ষীণ নক্ষত্রালোকে চারিদিক চাহিয়৷ দেখিল । দেখিল, কোন দিকে কোন গ্রামের কোন চিহ্ন নাই--কেবল অনন্ত প্রান্তর, আর সেই কলনাদিনী নদী ; মনুষ্যের ত কথাই নাই- কোন দিকে আলো দেখা যায় না—গ্রাম দেখা যায় ন—বৃক্ষ দেখা যায় না-পথ দেখা যায় ন-—শুগাল কুকুর ভিন্ন কোন জন্তু দেখা যায় না— কলনদিনী নদীপ্রবাহুে নক্ষত্র নাচিতেছে দেখা যায় । দলনা মৃত্যু নিশ্চয় করিল। সেইখানে প্রস্তরমধ্যে নদীর অনতিদূরে দলনী বসিল । নিকটে ঝিল্লী রব করিতে লাগিল— নিকটেই শৃগাল ডাকিতে লাগিল । রাত্রি ক্রমে গভীর হুইল— অন্ধকার ক্রমে ভামতর হইল । রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে, দলনী মহাভয় পাইয়া দেখিল, সেই প্রাস্তরমধ্যে এক দীঘাকার পুরুষ এক বিচরণ করিভেছে । দীর্ঘাকৃতি পুরুষ বিনা বাকো দলনীর পাশ্বে আসিয়া বসিল । আবার সেই ! এই দীর্ঘাকৃতি পুরুষ শৈবলিনীকে তুলিয়া লইয়া ধীরে ধীরে অন্ধকারে পর্বতারোহণ করিয়াছিল ।