পাতা:বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস গ্রন্থাবলী (দ্বিতীয় ভাগ).djvu/৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুর্গেশনন্দিনী “আয়েষ, তুমি রমণীরত্ন । জগতে মনঃপীড়াই বুঝি বিধাতার ইচ্ছা ! আমি তোমার কোন প্রত্যুত্তর লিখিতে প্লারিলাম না। তোমার পত্রে আমি কাতর হইয়াছি । এ পত্রের ষে উত্তর, তাহ এক্ষণে দিতে পারিলাম না। আমাকে ভুলিও না । বাচিয়া থাকি, তবে এক বৎসর পরে ইহার উত্তর দিব ।” দূত এই প্রত্যুত্তর লইয়া আয়েষার নিকট প্রতি গমন করিল ৷ বিংশ পরিচ্ছেদ দীপ নিৰ্ব্বাণোন্মুখ ষে অবধি তিলোত্তম। আশ মানীর সঙ্গে আয়েষার নিকট হইতে বিদায় লইয়া আসিল্লাছিলেন, সেই পৰ্য্যন্ত আর কেহ তাহার কোন সংবাদ পায় নাই । তিলোত্তমী, বিমলা, আশ মানী, অভিরাম স্বামী, কাহারও কোন উদ্দেশ পাওয়া যায় নাই । যখন মোগল-পাঠানে সন্ধিসম্বন্ধ হইল, তখন বীরেন্দ্ৰসিংহ আর তৎপরিজনের অশ্রুতপূৰ্ব্ব দুর্ঘটনা সকল স্মরণ করিয়া উভয়পক্ষই সন্মত হইলেন যে, বীরেন্দ্রের স্ত্রীকন্যার অনুসন্ধান করিয়া তাহাদিগকে গড় মানদারণে পুনরবস্থাপিত করা যাইবে । সেই কারণেই ওসমান, খুজি ইস, মানসিংহ প্রভৃতি সকলেই তাহাদিগের বিশেষ অনুসন্ধান করিলেন ; কিন্তু তিলোত্তমীর আশ - মানীর সঙ্গে আয়েষার নিকট হইতে আসা ব্যতীত আর কিছুই কেহ অবগত হইতে পারিলেন না। পরিশেষে মানসিংহ নিরাশ হুইয়া এক জন বিশ্বাসী অনুচরকে গড়মান্দারণে স্থাপন করিয়া, এই আদেশ করিলেন যে “তুমি এই স্থানে থাকিয়৷ মৃত জায়গীরদারের স্ত্রী-কন্যার উদ্দেশ করিতে থাক ; সন্ধান পাইলে তাহাদিগকে দুর্গে স্থাপনা করিয়া আমার নিকট যাইবে ; আমি তোমাকে পুরস্কত করিব এবং অন্য জায়গীর দিব ।” এইরূপ স্থির করিয়া মানসিংহ পাটনায় গমনোদ্যোগী হইলেন । মৃত্যুকালে কতলু খার মুখে যাহা শুনিয়াছিলেন, তছুবণে জগতসিংহের হৃদয়মধ্যে কোন ভাবান্তর জন্মিয়াছিল কি না, তাহ কিছুই প্রকাশ পাইল না । জগৎসিংহ অর্থব্যয় এবং শারীরিক ক্লেশ স্বীকার করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সে যত্ন কেবল পূৰ্ব্বসম্বন্ধের স্থতিজনিত, কি যে যে অপরাপর কারণে মানসিংহ প্রভৃতি সেইরূপ যত্ন প্রকাশ করিয়াছিলেন, সেই সেই কারণসভূত, কি ২য়—১০ ፃ<> পুনঃসঞ্চারিত প্রেমানুরোধে উৎপন্ন, তাহ কেহই বুঝিতে পারে নাই । ষত্ব যে কারণেই হইয়া থাকুক, বিফল হইল । মানসিংহের সেনাসকল শিবির ভঙ্গ করিতে লাগিল ; পরদিন প্রভাতে “কুচ” করিবে। যাত্রার পূৰ্ব্ব দিবস অশ্ববল্গায় প্রাপ্ত লিপি পড়িবার সময় উপনীত হইল। রাজপুত্র কৌতুহলী হইয়৷ লিপি খুলিয়। পাঠ করিলেন । তাহাতে কেবল এইমাত্র লেখা আছে —“যদি ধৰ্ম্মভয় থাকে, যদি ব্ৰহ্মশাপের । ভয় থাকে, তবে পত্রপাঠমাত্র এই স্থানে স্ত্র আসিবে । ইতি • —অহং ব্রাহ্মণঃ } রাজপুত্র লিপিপাঠে চমৎকৃত হইলেন। একবার মনে করিলেন, কোন শক্রর চাতুরীও হইতে পারে, যাওয়া উচিত কি ? রাজপুত হৃদয়ে ব্ৰহ্মশাপের ভয় ভিন্ন অন্ত ভয় প্রবল নহে ; সুতরাং ষাওয়াই স্থির হইল । অতএব নিজ অতুচরবর্গকে আদেশ করিলেন যে, যদি তিনি সৈন্ত্যযাত্রার মধ্যে না আসিতে পারেন, “ তবে তাহারা তাহার প্রতীক্ষায় থাকিবে না ; সৈন্ত অগ্রগামী হয়, হানি নাই, পশ্চাৎ বৰ্দ্ধমানে কি রাজমহলে তিনি মিলিত হইতে পারিবেন । এইরূপ আদেশ করিয়া জগতসিংহ একাকী শালবন অভিমুখে যাত্রা করিলেন । পূৰ্ব্বকথিত ভগ্নাটালিকা দ্বারে উপস্থিত হইয়৷ রাজপুত্ৰ পূৰ্ব্ববং শালবৃক্ষে অশ্ববন্ধন করিলেন । ইতস্ততঃ দেখিলেন, কেহ কোথাও নাই। পরে অট্টালিকামধ্যে প্রবেশ করিলেন । দেখেন, প্রাঙ্গণে পূৰ্ব্ববৎ একপাশ্বে সমাধিমন্দির, একপাশ্বে চিতাসজ্জা রহিয়াছে ; চিতাকাষ্ঠের উপর এক জন ব্রাহ্মণই বসিয়া আছেন। ব্রাহ্মণ অধোমুখে বসিয়া রোদন করিতেছেন। রাজকুমার জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, আপনি আমাকে এখানে আসিতে আজ্ঞা করিয়াছেন ?” ব্রাহ্মণ মুখ তুলিলেন ; রাজপুত্র জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া জানিলেন, ইনি অভিরাম স্বামী । - রাজপুত্রের মনে একেবারে বিস্ময়, কৌতুহল, আলাদ, এই তিনেরই আবির্ভাব হইল ; প্রণাম করিয়া ব্যগ্রতার সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “দর্শন : জন্য যে কত উদ্যোগ পাইয়াছি, কি বলিব । এখানে । অবস্থিতি কেন ?” অভিরাম স্বামী চক্ষু মুছিয়া কহিলেন, “আপাততঃ এইখানেই বাস ।” - স্বামীর উত্তর গুনিতে ন৷ শুনিতেই রাজপুত্র প্রশ্নের উপর প্রশ্ন করিতে লাগিলেন।