পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ֆ8Եr বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড করবে। এক সময় ভাবছিলাম তবে কি আমাকে গুলি করেছে, আমার তখন অনুভূতি নেই। কি হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। এই মড়ার মত অবস্থায় কতক্ষণ কেটেছে বলতে পারি না। এক সময় আমার মাথার কাছে মেয়ে-ছেলেদের ও বচ্চাদের কান্না শুনতে পেলাম। চোখ খুলে দেখি সুইপার, দারোয়ান ও মালিদের বাচ্চারা ও মেয়ে-ছেলেগুলি মৃত স্বামী কিংবা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে। তখনও অনেকে মরেনি। কেউ পানি চাচ্ছে তাদের কেউ কেউ পানি খাওয়াচ্ছে। এই সময় দেখলাম কে একজন গুলি খেয়েও হামাগুড়ি দিয়ে শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলে দেখি যেদিকে মিলিটারীর গাড়ী ও অসংখ্য মিলিটারী ছিল সেদিকে কোন গাড়ী বা মিলিটারী নেই। চতুর্দিকে একনজর দেখে নিয়ে মেয়ে- ছেলে ও বাচ্চাদের মধ্য দিয়ে নুয়ে নুয়ে বস্তির মধ্যে গেলাম। প্রথমে গিয়ে ঢুকি চিত্ৰালীর ঘরে। চিৎবালী ঘরে ছিল না। এক মহিলা ভয়ে কাঁপছিল। তাঁর কাছে পানি খেতে চাইলে সে একটি ঘটি দেখিয়ে দিল। পানি খেয়ে ওর ঘরের কোণে যে ঘুটে ছিল তার নীচে লুকিয়ে থাকতে চাইলাম। মহিলাটি আমাকে তক্ষুনি সরে যেতে বলল। তখন আমি বস্তির পাশের লেট্রিনে ঢুকে পড়ি। এই সময়ে রাজরবাগের দিকে গোলাগুলি হচ্ছিল। এক একটা প্রচণ্ড শব্দ থেমে থেমে গোলাবর্ষণ হচ্ছিল। একটু বাদেই দু’টি প্লেন উড়ে গেলো বুঝতে পারলাম। এভাবে অনেক্ষণ কাটালাম সেখানে। এক সময় একটা লোক এসে লেট্রিনের দরজা নাড়া দিল। দরজায় নাড়া শুনে ভাবলাম এইবার শেষ। মিলিটারী নিশ্চই এসেছে। খুলে দেখি একটি লোক, মিলিটারী নয়। লোকটি বলল তার নাম ঈদু। পুরনো বই বিক্রি করে রাস্তার ওপারে। বলল, হলে এসেছিল মেয়েদের মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আমি আছে শুনে আমাকেও নিয়ে যাবে। প্রথমে যেতে চাইনি। বুঝতে পারছিলাম না কি করব। বলল, সে সাথে যাবে। রাস্তা এখন পরিস্কার- কেনা মিলিটারী নেই। গায়ে সেই চাপ চাপ রক্ত নিয়ে ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। বকসি বাজারের কাছ দিয়ে যেতে দেখি ওদিকে কোন মিলিটারী যায়নি। অনেকে অজু করছে নামাজ পড়ার জন্য। সেদিন ছিল শুক্রবার এবং জুমার নামাজের সময়। ঈদু আমাকে জেলখানার পাশ দিয়ে বুড়িগঙ্গার পারে নিয়ে গেল। এক মাঝিকে অনুরোধ করায় নদী পার করে দিলো। নদীর ওপারে দেখা আমাদের হলের এক প্রাক্তন ছাত্র সুনির্মল চৌধুরীর সাথে। সে নিয়ে গেলো তার কর্মস্থল শিমুলিয়া। সেখান থেকে প্রথমে নবাবগঞ্জ ও পরে নিজগ্রাম বরিশালের ধামুরাতে চলে যাই। সে ভয়াল রাতে জগন্নাথ হলে যে হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল এখন সে দৃশ্য কল্পনা করলে আমার সমস্ত মানবিক অস্তিত্ব মুহুর্তে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এখনও আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারি না... অমি বেঁচে আছি। এ কি সত্যি ভাবতে গেলে তখন সবকিছু যেন তছনছ হয়ে যায়। সব কিছুই স্বপ্নের মত মনে হয়। আমি কি কোন এক নেশার ঘোরে সেদিন হল জীবনের নিত্যসঙ্গী ও বন্ধু-বান্ধবের লাশ টেনে মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। মার্চের শুরুতে এখনও মাঝে মাঝে ঐ দিনের কথা ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে যাই। সেই ঘোর এখনও আমার অস্তিত্বে তীব্র কশাঘাত করে। ‘বাসন্তিকা’ রক জয়ন্তী সংখ্যা মে, ১৯৭১