পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৫৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

©Ꮌ☾ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খন্ড যাব। পা দু’টো উল্টো করে বেঁধে তোমাকে চাবুক মারা হবে। জীবনে আর যাতে কারো মুখ দেখতে না পাও সে ব্যবস্থাও করা হবে। বেশ চিৎকার করেই অফিসারটি কথাগুলি বলেছিল। আমি প্রথমে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে বললাম ঘর থেকে। একটা হিংস্র দৃষ্টি সে আমাদের ওপর নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অফিসারটি চলে যাবার পর বেগম মুজিব তার ভবিষ্যত কৰ্মপন্থা স্থির করে নিলেন। সে দিনই তিনি অফিসারটির জঘন্য আচরণের সমস্ত ঘটনা প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সমস্ত উপর মহলেই লিখে জানালেন। কিন্তু এ ঘটনার পর থেকেই জামাল যেনো আরও অশান্ত হয়ে উঠলো। পালাবার জন্য সমস্ত সময় সে সুযোগ খুঁজতো। ২৭শে জুলাই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হাসিনার সন্তান হলো। আমাদের জীবনে এলো প্রথম নাতী। অথচ তাঁকে দেখবার জন্য আমাদের কাউকেই অনুমতি দেয়া হল না। ঘরের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলাম সেদিন। কেদেছিলাম পাক করুণাময় আল্লাহতায়ালার দরগায়। ৫ই আগষ্ট জামাল পালিয়ে গেল বাসা থেকে। কয়েকদিন আগে থেকেই পালিয়ে যাবার জন্য সে চেষ্টা চালাচ্ছিল। আমাকে বলছিল আমি যদি পালাতে পারি তাহলে ৩/৪ ঘন্টা ওদেরকে কোন খবর দিও না। জামাল পালাবার পর বুঝতে পারলাম যে ও পালিয়েছে। মন আবার অশান্ত হলো। যদি ধরা পড়ে শেষ হয়ে যায়, আবার সান্তনা পেলাম বাঁচলে এবার ও বাঁচার মতো বাঁচবে। বেলা দুটায় খাবারের সময় ওর খোঁজ পড়লো। খোঁজ খোঁজ, চারিদকে খোঁজ। কিন্তু জামাল কোথায়? সন্তানের খোঁজে আমি তখন দিশেহারা হবার ভান করলাম। সরাসরি চিঠি পাঠালাম ওপর মহলে। আমার ছেলেকে তোমরা ধরেছ। এবার ফিরিয়ে দাও। হানাদারদের তরফ থেকে কিছুই বলার ছিল না। কেননা আগেই আমি এ সম্পর্কে সজাগ হবার জন্য চিঠি লিখেছিলাম সর্বত্র। তদন্তের জন্য যে কর্নেলকে পাঠানো হয় সে মনে মনে শংকিত হলো হয়তো সত্যিই ওদের বাহিনীর কেউ জামালকে গুম করেছে। আমাকে সান্তনা দিয়ে কর্নেল ফিরে গেলেন। কিন্তু আমাদের ওপর কড়াকড়ির মাত্রা আরেক দফা বাড়লো। আগষ্ট মাসের শেষের দিকে জামালের চিঠি পেলাম। এ সময় আমার শাশুড়ীর শরীর বেশী খারাপ থাকায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। প্রতিদিন দু’ঘন্টার জন্য আমাকে হাসপাতালে যাবার অনুমতি দেয়া হলো। রোগী দেখার ভান করে ওপার থেকেও অনেকেই আসতো। ওদের মাথায় হাত রেখে হানাদার প্রহরীদের দেখিয়ে উপদেশ দিতাম ঠিকমতো ঘরে থেকে লেখাপড়া করার জন্য। এক ফাঁকে চিঠিটা হস্তগত করে নিজে সাথে করে নীচ পর্যন্ত পৌঁছে দিতাম ওদেরকে। ভীষণ ভয় লাগতো ওদের জন্য। কিন্তু আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কিইবা আমি করতে পারতাম তখন। ঠিক এভাবেই কেটে গেছে আমার দিন। সামান্য যা কিছু সঞ্চয় ছিল, তা দিয়েই চলতো আমার ছোট সংসার। দুঃখ-দৈন্য যন্ত্রণা দেহমনে সব কিছুই যেনো আটকে গিয়েছিল। প্রতি মুহুর্তে একটি সন্দেহ দিয়ে ঘেরা মৃত্যুর রাজত্বে ধুকে ধুকে দিন কাটতো আমাদের। প্রিয়জনরা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। জানতাম না কেমন আছে ওরা। স্বামীর জন্য আর চিন্তা করতাম না। কেননা আল্লাহ ছাড়া তাঁকে বাঁচাবার সাধ্য যে আর কারো নেই। একথা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পেরেছিলাম। তবু মাঝে মাঝে শিরা উপশিরাগুলো অবশ হয়ে আসতো। কোথায় আমার বুকের সন্তানেরা আর এই কারাগৃহে আবদ্ধ আমাদের জীবনের স্থায়ীত্বই বা কোথায়? নভেম্বরের শেষের দিকেই বুঝতে পেরেছিলাম ডিসেম্বরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আমার বন্দী জীবনে বাইরের সংবাদ আসার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু ট্রানজিষ্টার সেটটা ছিল। আমরা শুনেছিলাম ভারত