পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৮০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

769 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড কথাটা সবসময়ই আপেক্ষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে; প্রস্তুতি বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বুঝায়, সে অর্থে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে, সোভিয়েট রাশিয়া এবং চীনের মত শক্তিও প্রস্তুত নয়। প্রস্তুতি পর্বের সীমা থাকে না; উপরন্তু যদি আমরা দেখি যে কোন ন্যায্য কারণের জন্য এবং ভারতের প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা অপ্রস্তুত অবস্থায় আছি, তাহলে কেন বছর বছর আমাদের বাজেটে সমর বিভাগের জন্য ১১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করি? আর বাস্তবিকই আমাদের সামরিক বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃত হয়নি। এই ব্যাপারে কোন কিছু না করতে গেলে যে খরচ হবে তার পরিমাণ প্রত্যক্ষভাবে কিছু করতে গেলে, এমনকি একখন্ড সম্ভাব্য যুদ্ধ করতে হলেও তার চেয়ে বেশী হবে। বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে এক কোটির মত উদ্বাস্ত্তকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এখনই ভারতকে প্রস্তত থাকতে হবে। এই উদ্বাস্ত্তদের মধ্যে বাঙ্গালী হিন্দুদের সংখ্যাই দাঁড়াবে ৯০ লক্ষের মত। বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র স্থাপিত না হলে বাঙ্গালী হিন্দু উদ্বাস্তত্তরা কখনও দেশে ফিরে যাবে না। বাংলাদেশের উদ্বাস্ত্তদের জন্য মাথাপিছু ব্যয় দৈনিক দুটাকা করে ধরা হলে, ভারতকে তাদের জন্যে দৈনিক দু কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। ঐ উদ্বাস্ত্তদের ভরণ পোষণ ও পুর্নবাসনের বোঝা রাষ্ট্রসংঘ বহন করবে না এবং বহন করতে পারে না। একমাত্র প্যালেস্টাইনের উদ্বাস্তদের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। অবশ্য সেই ব্যতিক্রমও ঘটেছে, যুদ্ধের পর সন্ধির শর্ত পালনের বাধ্যবাধকতা হিসেবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকারীভাবে কোন যুদ্ধ ঘোষিত হয়নি- তাই সন্ধির শর্তের কোন প্রশ্নই এখানে নেই। কিছুকালের জন্য বিশ্ব সংস্থাগুলি কিছু সাহায্য দিতে পারে কিন্তু তারা নিশ্চয়ই উদ্বাস্ত্তদের জন্য দায়দায়িত্বের ভারগ্রহণ করবে না। এসব উদ্বাস্তর ভারে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। যদি ভারতে পূর্ব বাংলার সব বাঙ্গালী হিন্দুরাই চলে আসতে বাধ্য হয়, তাহলে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মধ্যে বিরাট ওলট-পালট ঘটবে এবং পরিণামে ভারতেও ভীষণ সাম্প্রদায়িক রক্তবন্যা বইতে পারে। এর ফলে এ দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যও বিপর্যস্ত হবে- শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে বর্তমান মন্ত্রীসভার এবং ভারতের পূর্ব অঞ্চলের রাজ্যসমূহের মন্ত্রীসভাগুলির পতন ঘটবে। সে অবস্থায় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ শিকেয় তুলে রাখতে হবে এবং উন্নয়নমূলক কাজগুলিকে বন্ধ রাখতে হবে। জনগণের নৈতিক মেরুদন্ড দ্রুত ভেঙ্গে পড়বে। তখর ভারতের ভেতরই গড়ে উঠবে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব। আর, চূড়ান্ত পর্যায়ে ভারত যুদ্ধকেও এড়িয়ে যেতে পারবে না। আহ যদি যুদ্ধ হয়ই, তাহলে এ যুদ্ধের যে খরচা পড়বে তার চাইতে দশগুণ বেশী খরচা পড়বে ভবিষ্যতের যুদ্ধে- যে যুদ্ধ ঘটবে পাকিস্তানের ইচ্ছায় ও পাকিস্তানের সুবিধামত। আমাদের এই উপমহাদেশের অগ্রগতির যাত্রাপথে বাংলাদেশ হল হারানো সূত্র। সাম্প্রদায়িকতার জগদল পাথরে ধাক্কা খেয়ে ভারতকে তার আদর্শ থেকে সরে আসতে হয়েছে। পাকিস্তানবাদ এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের সত্যিকারের জবাব হিসেবেই বাংলাদেশের অভু্যদয় ঘটেছে। ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল ও ভারতের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটলে, এই উপমহাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণভেদ এবং সঙ্কীর্ণতাবাদের মত সব শক্তিগুলিই বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ আমাদের সামনে এক বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে- যা হয়তো আগামী আর এক শতাব্দীর মধ্যে আবার আমরা পাব না। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে যদি পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তাহলে পাকিস্তান যে পূর্ব বাংলার কয়েক দিনের বেশী টিকে থাকতে পারবে না, তা সে ভালভাবেই জানে। কিন্তু এই ভীষণ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া আর কোন পথ নেই। কারণ, পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকরা নিজেদের জনগণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভারতের কাছে পরাজয় বরণকেই শ্রেয় মনে করবে। পশ্চিমাঞ্চলেই চূড়ান্তভাবে যুদ্ধের নিষ্পত্তি হবে। এজন্য উত্তরাঞ্চল থেকে সৈন্যদের সরিয়ে আনার প্রয়োজন হবে না। পূর্বাঞ্চলে পাকবাহিনীকে উচ্ছেদ করা হলে, - যা কয়েকদিনের ব্যাপার মাত্র - আমরা স্বচ্ছন্দেই পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমফ্রন্টে শক্তি বৃদ্ধি করতে পারব। সম্ভবত এক মাসেরও অধিক কাল পশ্চিম পাকিস্তান যুদ্ধে টিকে