পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৮৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

803 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড মাড়োয়ারি রিলিফ সেসাইটির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৫ হাজার পরিবারকে বাসনপত্র দেওয়া হয়েছে এবং এছাড়া অনেককে কাপড় জামা ইত্যাদি। এছাড়া ওরা সীমান্ত অঞ্চলে ৫০ বেডের একটা হাসপাতালও খুলবেন। বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি সমস্যা প্রকট হয়েছে। যথাঃ (১) জ্বালানী, (২) শৌচাগার এবং (৩) পানীয় জল। সরকার রেশন দেবার মালিক, জালানি দেবার কেউ নয়। ফলে এতদিন আশ্রয়প্রার্থীরা নিজেরাই এপাশ ওপাশ থেকে তা সংগ্রহ করে নিচ্ছিলেন। এদিকে জঙ্গল নেই। অতএব স্থানীয় গৃহস্থদের জিনিসেই হাত পড়ছিল। এবং পশ্চিমবঙ্গের লোক শত অসুবিধা সহ্য করেও শরণার্থীদের সাহায্য করে অতিথিবৎসলতার প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন, এই বর্ষায় কী হবে? গৃহস্থরা নিজেরাই তো জ্বালানীর অভিযোগে ভুগবেন। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের উচিত অবিলম্বে শরণার্থীদের জন্য জ্বালানীর ব্যবস্থা করা। নাহলে ক্রমে জ্বালানীর অভাবে শরণার্থীদের হাঁড়িই যে চড়বে না, তাই নয়, আইন-শৃঙ্খলাগত শোচনীয় অবস্থারও সৃষ্টি হবে। রবিবার শিবিরের পর শিবির গিয়ে দেখেছি, নূ্যতম স্বাস্থ্যরক্ষার কোনও ব্যবস্থাই নেই। একে এইসব শিবিরে লোক সংখ্যার তুলনায় পায়খানার সংখ্যা শোচনীয়ভাবে কম, (আবরু রক্ষার প্রশ্ন তুলছিই না) তারপর উপর বৃষ্টির জলে সেগুলো এখন থৈ থৈ, একেবারে অব্যবহার্য হয়ে উঠেছে। মাঠগুলোও ভেসে উঠছে, জেগে আছে শুধু পাকা সড়ক। অতএব কিছুদিন পরে অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। এর পরে দুর্গন্ধে ওদিকে তিষ্ঠানো যাবে না। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানীয় জল সরবরাহের সংকট। এমন শিবিরও আছে যার লোকসংখ্যা ১৫ হাজারেরও উপর, কিন্তু মাত্র একটি টিউবওয়েল কাজ করছে। বাকিগুলো বিকল। পরিশ্রত পানীয় জলের অভাব, শিবিরে সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার অব্যবস্থা মারাত্মক সব রোগের সৃষ্টি করতে এবং সকলের জীবন বিপন্ন করে তুলবে। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কয়েকজন চিকিৎসক গত কয়েকদিন ধরে যাহারা শিবিরে দল বেঁধে আসছেন এবং প্রাণপণে চেষ্টা করছেন। সেবা করতে দেখে ভাল লাগল। ওদের মধ্যে দু’জন, ডঃ বিমল বসু এবং ডঃ নন্দ সরকার জানালেন। সাহারা শিবিরে (কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতি শিবির পরিচালনা করছেন) গত সপ্তাহ থেকে তারা মহামারীর আকারে যে উদরাময়, চোখের রোগ, ব্রংকাইটিস, বসন্ত, হাম, এমনকি যক্ষা রোগ দেখা দিয়েছে, তার চিকিৎসা করছেন। তারা রেডক্রস, ক্যালকাটা কেমিক্যালস, হাওড়া লায়নস ক্লাব, দেজ মেডিক্যাল, ষ্ট্যাডমেড, ইষ্ট ইনডিয়া ফারমাসিউটিক্যালস প্রভৃতি সংস্থার কাছ থেকে কিছু ওষুধপত্র পেয়েছেন তবে তাতে প্রয়োজন মিটছে না। সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করেও এ পর্যন্ত তারা কোনও সাহায্য পাননি। সময়মত সাহায্য পেলে তারা অনেক জীবন বাঁচাতে পারতেন। বর্ষা শুরু হতে না হতেই সমস্যার তীব্রতা এবং ব্যাপকতা এইভাবে বেড়ে চলেছে। যার পরিণতি লক্ষ লক্ষ ঘরছাড়া শরণার্থীদের ঠেলে নিয়ে চলেছে একটি মাত্র লক্ষে মৃত্যুর দুয়ারে। এর বিকল্প কী? বিভিন্ন শরণার্থীকে সারাদিন ধরে জিজ্ঞাসা করেছি। ওরা বলেছে দেশে ফিরে যাওয়া। ওরা বলেছে, আমরা ঘরে ফিরতে প্রস্তত, আপনারা আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিন। নিরাপত্তার ব্যবস্থা বলতে কী বোঝতে চান? কী চান আপনারা? রামপালের ছাত্র কালিদাস রায়, শিক্ষক বিকাশ চন্দ্র সরদার, গ্রামের মাতববর বিজয়কৃষ্ণ মন্ডল- সারাদিন তারা রেশন নেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, সারাদিন ধরে বৃষ্টিতে ভিজছেন, ক্লান্ত তারা, অবসন্ন একবাক্যে বললেন, মুজিবের সরকার, একমাত্র মুজিবের সরকার হলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হলেই আমরা নিরাপদ হব। ঘরে ফিরে যাব।” এর জন্য প্রয়োজেন তারা অস্ত্র ধরবেন। যদি তাদের এ কাজে লাগানো হয়, তবে এই দন্ডেই তারা রেশনের লাইন ছেড়ে চলে যাবেন! প্রাণ বলি দিতে তারা প্রস্তত। প্রশ্ন এই, এ ব্যবস্থা কে করবেন? আগে করা হবে কি? হলে এই তো সময়, কেননা জীবণীশক্তি কিছু এখনও অবশিষ্ট আছে যত দেরি হবে, মৃতের স্তুপে ভারত ততই ভরে যাবে।