পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/৩৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
৩১৪
শিরোনাম সূত্র তারিখ
সাহায্যের আহবান জানিয়ে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির বিবৃতি দৈনিক যুগান্তর ৮ এপ্রিল, ১৯৭১

বাংলাদেশের সাহায্যে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির আবেদন

 বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি নামে একটি সংস্থা সম্প্রতি গঠিত হয়েছে। ঐ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন শ্রী তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, এবং সম্পাদক হিসেবে আছেন, শ্রী মণিন্দ্র রায়, শ্রী নররেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও শ্রী দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। সমিতির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছেন ডাঃ মণীন্দ্রলাল বিশ্বাস এবং সহ-সভাপতিমণ্ডলীতে আছেন-সর্বশ্রী অজিত দত্ত, অন্নদা শংকর রায়, অমলাশংকর, উদয়শংকর, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, গোপাল হালদার, জ্যোতি দাশগুপ্ত, দক্ষিণারঞ্জন বসু, ডাঃ নীহার কুমার মুন্সী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, মনোজ বসু, মন্মথ রায়, শম্ভু মিত্র, সন্তোষ কুমার ঘোষ, সরযুবালা দেবী, সুচিত্রা মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুশোভন সরকার এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

 সমিতির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে নিম্নলিখিত আবেদন প্রচার করা হয়েছেঃ

 ইয়াহিয়া ও তার বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা, স্বাধিকারবোধ ও মানবিক মর্যাদার পবিত্র অনুভবকে ট্যাংকের চাকায় পিষে ফেলতে চাইছে। প্রকৃতির আশীর্বাদ, কবির স্বপ্ন নদী-মেঘলা-শোভিতা এই শ্যামল ভূখণ্ড ও তার সাড়ে সাত কোটি মানব সন্তানকে আধুনিকতম মারণাস্ত্রের সাহায্যে একদল নরপিশাচ ঝলসে মারতে চায়।

 নাপাম বোমার আগুনে তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শনগুলি, বহু স্মৃতি ঘেরা জনবসতি অঞ্চল, এমনকি গায়ের সবুজ মাটিকে পর্যন্ত পুড়িয়ে দিচ্ছে। গোটা জাতির স্বপ্ন, শ্রম আর সম্পদে নির্মিত সেতু, বাঁধ ও প্রকল্পগুলিকে তারা বেছে বেছে ধ্বংস করছে। শাশ্বত-সাধনার পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এই জংগী চক্র কামান দেগে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বিখ্যাত কারমাইকেল কলেজ এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মূল্যবান গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার ঘাতকরা ধ্বংস করেছে। সংবাদপত্রের কার্যালয়কে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। বোমা ফেলে মর্টার ছুড়ে হাসপাতাল ভবনে জ্বেলেছে নরকের ভয়াবহ আগুন। মন্দির-মসজিদচার্চের পবিত্রতাটুকুও ঐ যুদ্ধোন্মাদ রাক্ষসদের নখ এবং দাঁতের কামড় থেকে রক্ষা পায়নি।

 হত্যা ও রক্তের নেশায় জঙ্গী ইয়াহিয়া চক্র উন্মাদ হয়ে গেছে। খবর এসেছে কয়েক লক্ষ লোক মারা গিয়েছে-নিজেদের দেশে মানুষের অধিকারে মায়ের ভাষায় কথা বলে যারা শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিল। অতর্কিত আক্রমণের শিকার, কামানোর খোরাক, কয়েক লক্ষ অমৃতের সন্তান পচা গলা শবদেহ হয়ে শহরে বন্দরে গ্রামে শুকুনির খাদ্য হচ্ছে। তাদের কবর দেবার, দাহ করবার কোন ব্যবস্থা হয়নি। ইয়াহিয়ার উদ্যত সংগীন কয়েক লক্ষ শবেদেহকে নিয়ত পাহারা দিচ্ছে, দেশবাসী যাতে শহীদদের প্রাপ্ত মর্যাদাটুকু দিতে না পারে।

 নর-নারী শিশু-বৃদ্ধ কে মরেনি? শ্রমিক কৃষক বুদ্ধিজীবী চাকুরে ব্যবসায়ী-কে মরেনি? শিল্পী, সাহিত্যিক সংবাদিক অধ্যাপক, কে মরেনি?

 দানবরা মায়ের দুই স্তন কর্তন করে রক্তের উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার মধ্যে অবোধ শিশুর মুখ চেপে ধরেছে। আড়াই বৎসরের বাচ্চাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে গোলা ছুড়েছে। ইজ্জত লুট করে তারপর বাংলাদেশের মা ও বোনদের সংগীন দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান আচার্যদের সারিবন্দি দাঁড় করিয়ে গুলি ছুড়েছে। হাসপাতালের প্রত্যেকটি রোগীকে গুনে গুনে খুন করেছে।