পাতা:বিবিধ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৫৯).pdf/২১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSo বিবিধ প্ৰবন্ধ-দ্বিতীয় ভাগ বর্ণগত পার্থক্যের অনেক লাঘব হইয়াছে। দুৰ্ভাগ্যক্রমে শিক্ষা এবং সম্পত্তির প্রভেদে অন্য প্রকার বিশেষ পার্থক্য জন্মিতেছে । সেই পার্থক্যের এক বিশেষ কারণ ভাষাভেদ । সুশিক্ষিত বাঙ্গালীদিগের অভিপ্ৰায়সকল সাধারণতঃ বাঙ্গালা ভাষায় প্রচারিত না হইলে, সাধারণ বাঙ্গালী ভঁহাদিগের মৰ্ম্ম বুঝিতে পারে না, তঁাহাদিগকে চিনিতে পারে না, তঁহাদিগের সংস্রবে। আসে না। আর, পাঠক বা শ্রোতাদিগের সহিত সহৃদয়তা, লেখকের বা পাঠকের স্বতঃসিদ্ধ গুণ। লিখিতে গেলে বা কহিতে গেলে, তাহা আপনা হইতে জন্মে । যেখানে লেখক বা বক্তার স্থির জানা থাকে যে, সাধারণ বাঙ্গালী তাহার পাঠক বা শ্রোতার মধ্যে নহে, সেখানে কাজে কাজেই তাহাদিগের সহিত তাহার সঙ্গদয়তার অভাব ঘটিয়া উঠে । যে সকল কারণে সুশিক্ষিত বাঙ্গালীর উক্তি বাঙ্গালা ভাষাতেই হওয়া কত্ত্বও ব্য, তাহা আমরা সবিস্তারে বিবৃত করিলাম। কিন্তু রচনা-কালে সুশিক্ষিত বাঙ্গালীর বাঙ্গালা ভাষা ব্যবহার করার একটি বিশেষ বিপ্ন আছে । সুশিক্ষিতে বাঙ্গালা পড়ে না । সুশিক্ষিতে যাহা পড়িবে না, তাহ সুশিক্ষিতে লিখিতে চাঠে না । “আপৱিতোষা দ্বিাদুষাং ন সাধু মন্যে প্রযোগ বিজ্ঞানম।” আমরা সকলেই স্বাথ্যাভিলাষী। লেখক মাত্রেই যশের অভিলাষী। যশঃ, সুশিক্ষিতের মুখে । অন্যে সদসৎ ধিঙ্গারক্ষম নহে ; তাহদের নিকট যশঃ হইলে, তাহাতে রচনার পরিশ্রমের সার্থকতা বোধ হয় না । সুশিক্ষিতে না পড়িলে সুশিক্ষিত ব্যক্তি লিখিবে না । এ দিকে কোন সুশিক্ষিত বাঙ্গালীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, “মহাশয়, আপনি বাঙ্গালী-বাঙ্গালা গ্ৰন্থ বা পত্রাদিতে আপনি এত হতােদর কেন ?” তিনি উত্তর করেন, “কোন বাঙ্গালা গ্রন্থে বা পত্রে আদর করিব ? পাঠ্য রচনা পাইলে অবশ্য পড়ি।” আমরা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি যে, এ কথার উত্তর নাই । যে কয়খানি বাঙ্গালা রচনা পাঠ্যযোগ্য, তাহা দুই তিন দিনের মধ্যে পড়িয়া শেষ করা যায় । তাহার পর দুই তিন বৎসর বসিয়া না থাকিলে আর একখানি পাঠ্য বাঙ্গালা রচনা পাওয়া যায় না। এইরূপ বাঙ্গালা ভাষার প্রতি বাঙ্গালীর অনাদরেই বাঙ্গালার অনাদর বাড়িতেছে। সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা রচনায় বিমুখ বলিয়া সুশিক্ষিত বাঙ্গালী বাঙ্গালা রচনা পাঠে বিমুখ। সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালা পাঠে বিমুখ বলিয়া, সুশিক্ষিত বাঙ্গালীরা বাঙ্গালী রচনায় বিমুখ ।