পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S88 বিভূতি-রচনাবলী আমি বললাম—কেন ওকে মিথ্যে বকছ হিরণ, ছেলেমানুষকে—ওর দোষ কি, আমি যাবই, কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না । হিরণ্ময়ী ঝঙ্কার দিয়ে বললে—আচ্ছা আচ্ছা হবে। যাবেন তো যাবেন। সেদিন সন্ধ্যাবেল অনেকদিন পরে ও রান্নাঘরে এসে ঢুকল। বললে–গুড়ের ভাড়টা কই ! —সেটা তিনকড়িদের দিয়ে দিইছি। দু-দিনের মত থানিকটা গুড় ওই বাটিতে রেখেছি— দুটো দিন ওতেই চলে যাবে। হিরন্ময়ী অন্য দিনের মত বসল না, দাড়িয়ে রইল। একবার বাইরে যাবার সময় ও সরে দরজার কপাটের আর দেওয়ালের মধ্যের যে জায়গাটুকু, সেখানটাতে দেখি জড়সড় হয়ে দাড়িয়েছে। বলতে গেলাম—ওখানে না, ওখানে না,---কাপড়ে কালিটালি লেগে যাবে কি না —বার হয়ে এস— ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখি ওর ডাগর চোখ দুটি জলে ভরে টল টল করছে। হিরন্ময়ীর চোখে জল ! অবাক্, এ দৃশ্ব তো কখনও দেখি নি ] ও জল-ভরা ধরা-গলায় বললে—আপনি বলুন, যাবেন না মাস্টার মশায়। আমি তখন পাঠশালায় বলতে পারলাম না ওদের সামনে। ওর হাসবে তাহলে। আর কেউ নয়—আর সবাই আমার ভর কয়ে, কেবল ওই মন্টটা বড় झुछे, ! তারপর আমার দিকে চোখের জল আর হাসি-মিশানো এক অপূৰ্ব্ব দৃষ্টিতে চেয়ে বললে— যাবেন না, কেমন ? হিরন্ময়ী এই প্রথম দুৰ্ব্বলতা প্রকাশ করলে—এর আগে কখনও দেখি নি। ছেলেমানুষ, ও কথা তো তেমন জানে না, কিন্তু ওর ডাগর সজল চোখের মিনতিপূর্ণ দৃষ্টি ওর ভাষার দৈন্য ঘুচিয়ে দিয়ে এমন কিছু প্রকাশ করলে—এক জাহাজ কথাতে তা প্রকাশ করা যেত না। আমার মনে অনুতাপ হ’ল—কেন ওকে মিথ্যে র্কাদালাম সন্ধ্যাবেলাটিতে ? জীবনের এই সব মুহূর্তেই না মানুষে ভগবানকে প্রত্যক্ষ করে ? ব্রাউনিঙের 'পলিন কবিতার সেই সৰ্ব্বহার লোকটির মত আমার মনও বলে উঠল –I believe in God and Truth and Love 1.-- ওর হাতটি ধীরে দরজার কপাটের ফাক থেকে বার ক’রে এনে আস্তে আস্তে পিড়ির ওপর বসিয়ে দিয়ে বললাম—ওখানে সন্ধ্যাবেলা দাড়াতে নেই। বিছোটছে বেরুতে পারে—এখানে বোস। রুটিগুলো বেলে দাও দিকি, লক্ষ্মী মেয়ে ; আমি যাব না-বলছ তুমি যখন, তখন আর যাব না। চোখের জল ফেলতে আছে অবেলায় ? ছিঃ– তার পরই রুটি তৈরী করতে বসে যে হিরন্ময়ী সেই হিরন্ময়ী—সেই মুখরা বালিক, যে সকল কথা এমন কর্তৃত্বের মুরে বলে যেন ওর কথা না মেনে চললে ও ভয়ঙ্কর একটা কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করবে, সেটা আবার খুব কৌতুকপ্রদ এবং ভেবে দেখলে করুণ বলেই মনে হয়, যখন বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে যে মুখের বুলিটুকু ছাড়া ওর হুকুমের পেছনে ওর কোন জোর থাটাবার নেই—নিতান্ত অসহায় ও নিরুপায় । প্রেম আসে এই সব সামান্ত তুচ্ছ খুটিনাটি স্বত্র ধরে। বড় বড় ঘটনাকে এড়ানো সহজ, কিন্তু এই সব ছোট জিনিস প্রাণে গেঁথে থাকে—ফলুই মাছের সরু চুল-চুল কাটার মত। গায়ের জোরে সে কাটা তুলে ছুড়ে ফেলে দিতে গেলে, বিপদের সম্ভাবনা বাড়ে বই কমে না। পুরুষমাহৰ প্রেমের ব্যাপারে আত্মরক্ষা করে চলতে পারে না যেটা অনেক সময় মেয়ের পারে। যেখানে যা হবার নয়, পাবার নয়, সেখানেও তারা বোকার মত ধরা দিয়ে বসে থাকে