পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উৎকর্ণ - ২৯৭ জংশনে। নিম্ন আসামের ভূমি জলমগ্ন, নলখাগড়ার বনে পরিপূর্ণ। আমিনগাঁওতে কামাখ্যা দেবীর মন্দিরের পাণ্ডারা এসে জুটলো। কোন রকমে তাদের হাত এড়িয়ে পাণ্ডুঘাটে উঠলুম স্টীমারে। তারপর মোটরে গৌহাটি হয়ে শিলং রওনা হলুম। এ পথের বন-বনানী ও খাসিয়া জয়স্তিয়া পাহাড়ের দৃশ্য ভারি সুন্দর। এ পথের উপযুক্ত বর্ণনা কেউ করেনি। শুধু মাষ্টলের পর মাইল দুধারে উজ্জ্বল শৈলমাল, মধ্যে মধ্যে ঝরনা বা পাৰ্ব্বত্য নদী, নদীখাতে ভীষণ ঘন বন, কত বনফুল, কত বিচিত্র গাছপাল, মোটা মোট লতা গাছে গাছে ঝুলছে, শেওলা জমেচে বড় বড় গাছের গায়ে, নিবিড় অন্ধকার বনানীর তলদেশে সত্যিকার ট্রপিক্যাল জঙ্গল। ছোটনাগপুর অঞ্চলের পাহাড় এর তুলনায়, উচ্চতায় বা বনশোভায় কিছুই নয়। এরকম নিবিড় ট্রপিক্যাল বন সেখানে নেই, সম্ভবও নয়। আর একটা আশ্চর্যা ব্যাপার, আমাদের কুঠীর মাঠের সেই ছোট এডাঞ্চির বন এখানে পাহাড়ের সর্বত্র—অন্ততঃ তিন হাজার ফুট উচুতেও আমি ঐ গাছের বন দেখেচি। আসামের পাহাড়েই কি ছোট এড়াঞ্চি গাছের আদি বাসস্থান ? বৈকালে সুপ্রভার সঙ্গে দেখা করতে গেলুম লাবানে। পথে দেথি অবিকল সুপ্রভার মত একটি মেয়ে যাচ্ছে। ভাবলুম কে না কে ! একটু পরে দেখি মেয়েটি পিছন ফিরে আমার দিকে বার বার চাইচে । তারপর সে হঠাৎ দাডিয়ে পড়ল। বলে উঠল—আপনি ! চেয়ে দেখি সুপ্রভ । সে বললে—ওবেলা মোটর-স্টেশনে লোক পাঠিয়েছিলুম আপনার জন্যে—সে ফিরে এসে বল্লে, আপনি আসেননি। আসুন । সনৎ কুটীরে’ ও থাকে। সেখানে বীণাও এল দেখা করতে । চা খেয়ে ওর সঙ্গে বেড়াতে বেরুই। সঙ্গে রইল তার ভাইপো । প্রথমে ক্রিনোলাইন ফলস্ দেখে ও বল্লে, চলুন Spread Eagle falls দেখিয়ে আনি । তাই দেখাতে গিয়ে ও পথ হারিয়ে ফেললে। কতদূর শহরের বাইরে নিবিড় পাইনবনের দিকে বিজন পথে চলে গেল। তথন সন্ধ্যা হয়ে এসেচে। পথে থাসিয়া দস্তার ভয়। ওর মুখ দেখি শুকিয়ে গিয়েচে, যখন দেখা গেল সত্যিই ষণ্ডামার্কা গোছের দুজন লোক অন্ধকারে আমাদের দিকে এগিয়ে আসচে। ও বল্লে—আমার ভয় করচে । কি বিপদ ! ছেলেমানুষের কাও ৷ তবে বলেছিল কেন যে আমি জানি Spread Eagle fallsএর পথ ! যাই হোক, অবশেষে নিরাপদে শহরে পৌঁছে ট্যাক্সি করে ওকে লাবানে পৌছে দিয়ে আমি হেঁটে হোটেলে ফিরি। কারণ ও ছেলেমানুষ, আর হাটতে পারবে না দেখলুম। শুধু আমায় দৃষ্ঠাবলী দেখাবার উৎসাহেই ও অতটা গিয়েছিল। বড় ভাল লাগল এই বেড়ানোটা আজকার । জীবনে এ একটা স্মরণীয় দিন। যেন অন্ত জগতে এসে গিয়েচি। শিলংএর শোভা তো অদ্ভুত বটেই—তা ছাড়া সুপ্রভার মত মমতাময়ী মেয়ের সাহচৰ্য্য ও সহানুভূতি ক'জন পায় ? হোটেলে এসেই কালকের সেই গরীব রিকৃশাওয়ালার কথা মনে এসে দুঃখে চোথে জল এল। যদি আবার তার দেখা পাই! আমার নিষ্ঠুরতার প্রায়শ্চিত্ত করব । বাস্তবিকই অন্যায় হয়ে গিয়েচে । কিন্তু কী ভালই লেগেছে আজ সন্ধ্যায় বনফুল-ফোটা পাইনবনের পথে মুগ্রভার সঙ্গে বেড়ানোটা। আর কি সুন্দর দৃপ্ত চারিধারে, এমন ঢেউখেলানো ঘন সবুজ শৈলশীর্ষ অন্ত কোন জায়গায় দেখিনি। ছোটনাগপুরের পাহাড়ের চেয়ে শিলং-এর পাহাড়রাজি অনেক বেশী সুন্দর। অনেকদিন আগে একবার ডায়েরীতে লিখেছিলুম যে, ছোটনাগপুরের পাহাড় আর বাংলাদেশের