পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ર૭ বিভূতি-রচনাবলী ক'রে বাড়ি ফিরবে—ওতে আমার মনে বড় লাগে । হঠাৎ আমি অবাক হয়ে পথের ওপারে চেয়ে রইলুম-ওপারে সামু নাপিতের মুদিখানার দোকানটা আর নেই, পাশেই সে ফিতে খুন্সির দোকানটাও নেই, তার পাশের জামার দোকানটাও নেই—একটা খুব বড় মাঠ, মাঠের ধারে বড় বড় বাঁশগাছের মত কি গাছের সারি, কিন্তু বাঁশগাছ নয়। দুপুরবেলা নয়, বোধ হয় যেন রাত্রি—জ্যোৎস্না রাত্রি-দূরে সাদা রঙের একটা অদ্ভুত গড়নের বাড়ি, মন্দিরও হতে পারে। - নিমগাছের গুড়িটাতে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ছিলুম, সাগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকে ভাল দেখতে পাওয়া গেল, তখনে তাই আছে জ্যোৎস্নাভরা একটা মাঠ, কি গাছের সারি—দুরের সাদা বাড়িটা। দু-মিনিট.পাচ মিনিট। তাড়াতাড়ি চোখ মুছলাম, আবার চাইলুম—এখনও অবিকল তাই । একেবারে এত স্পষ্ট, গাছের পাতাগুলো যেন গুমতে পারি, পাখিদের ডানার সব রঙ বেশ ধরতে পারি। তার পরেই আবার কিছু নেষ্ট, খানিকক্ষণ সব শূন্ত—তার পরেই সামু নাপিতের দোকান, পাশেই ফিতে খুন্সির দোকান। বাড়ি চলে এলুম। যখনই আমি এই রকম দেখি, তখন আমার গা কেমন করে-হাতে পায়ে যেন জোর নেই এমনি হয়। মাথা যেন হালকা মনে হয়। কেন এমন হয় আমার ? কেন আমি এ-সব দেখি ? কাউকে এ কথা বলতে পারিনে, মা, বাবা, দাদা, সীত, কাউকে নয়। আমার এমন কোনো বন্ধু বা সহপাঠী নেই, যাকে আমি বিশ্বাস করে সব কথা খুলে বলি। আমার মনে মনে যেন কে বলে—এরা এসব বুঝবে না। বন্ধুরা হয়ত হেসে উঠবে, কি ওই নিয়ে ঠাট করবে। ওবেলা খেয়ে যাইনি। রান্নাঘরে ভাত খেতে গিয়ে দেখি শুধু সিমভাতে আর কুমড়োর ডাটাচচ্চড়ি। আমি ভাট খাইনে—সিম যদি বা খাই সিমভাতে একেবারেই মুখে ভাল লাগে না। মাকে রাগ করে বললুম—ও দিয়ে ভাত খাবো কি করে । সিমভাতে দিলে কেন ? সিমভাতে আমি খাই কখনও ? কিন্তু মাকে যখন আমি বকছিলুম আমার মনে তখন মায়ের ওপর রাগ ছিল না। আমি জানি আমাদের ভালো খাওয়াতে মায়ের যত্নের ক্রটি কোনো দিন নেই, কিন্তু এখন ম! অক্ষম, অসহায়—হাতে পয়সা নেই, ইচ্ছে থাকলেও নিরুপায় । মায়ের এই বর্তমান অক্ষমতার দরুন মায়ের ওপর যে করুণা সেটাই দেখা দিল রাগে পরিবৰ্ত্তিত হয়ে। চেয়ে দেখি মায়ের চোথে জল । মনে হ’ল এ সেই মা—চ-বাগানে থাকতে মিস নর্টনের কাছ থেকে আমাদের খাওয়ানোর জন্তে কেক্‌ তৈরি করবার নিয়ম শিখে বাজার থেকে ঘি ময়দা কিশমিশ ডিম চিনি সব আনিয়ে সারা বিকেল ধরে পরিশ্রম ক'রে কতকগুলো স্বাদগন্ধহীন নিরেট ময়দার ঢিপি বানিয়ে বাবার কাছে ও পরদিন মিস্নটনের কাছে হান্তাম্পদ হয়েছিলেন । তার পর অবিপ্তি মিস্ নর্টন ভাল ক'রে হাতে ধরে শেখায় এবং মা ইদানীং খুব ভাল কেকই গড়তে পারতেন। মা বাংলা দেশের পাড়াগায়ের ধরণ-ধারণ, রায়, আচার-ব্যবহার ভাল জানতেন নী—অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে চা-বাগানে চলে গিয়েছিলেন, সেখানে এক একা কাটিয়েছেন চিরকাল সমাজের বাইরে—পাড়াগায়ের ব্রত-নে পূজো আচ্চা আচার এসব তেমন জানা ছিল না । এদের এই ঘোর আচারী সংসারে এসে পড়ে আলাদা থাকলেও মাকে কথা সহ করতে হয়েছে কম নয় । পয়সা খাকলে যেটা হয়ে দাড়াত গুণ—হাত খালি থাকাতে সেটা হয়ে দাড়িয়েছিল