পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓbሥ বিভূতি-রচনাবলী ছলছল চোখে তার পাশে পাশে চলেচে । সেই দিন রাত্রে শুনলাম মেলার কলেরা দেখা দিয়েচে । পরদিন দুপুরবেলা দেখি বটতলার সামনের মাঠটা প্রায় ফাকা হয়ে গিয়েচে, অনেকেই পালিয়েচে । নিমৰ্চাদের কুঁড়েঘরের কাছে এসে দেখি নিমৰ্চাদের স্ত্রী বসে—আমায় দেখে কেঁদে উঠল। নিমৰ্চাদের কলেরা হয়েচে কাল রাত্রে—মেলার যারা তদারক কয়ে, তারা ওকে কোথায় নাকি নিয়ে যেতে চেয়েচে, মাঠের ওদিকে কোথায় । আমি ঘরে ঢুকে দেখি নিমৰ্চাদ ছটফট করচে, খুব ঘামচে । নিমৰ্চাদের স্ত্রী কেঁদে বললে—কি করি দাদাঠাকুর, হাতে শুধু যাবার ভাড়াটা আছে—কি করি কোথা থেকে— মেজবাবুকে কথাটা বললাম গিয়ে—তিনি বললেন—লোক পাঠিয়ে দিচ্চি, ওকে সিগ্রিগেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাও—মেলার ডাক্তার আছে সে দেখবে— নিমৰ্চাদের বৌ-এর কি কান্না ওকে নিয়ে যাবার সময় । আমরা বোঝালুম অনেক। ডাক্তার ইনজেকৃশন দিলে। মাঠের মধ্যে মাদুর দিয়ে সিগ্রিগেশন ক্যাম্প করা হয়েছে—অতি নোংরা বন্দোবস্ত। সেখানে সেবাশুশ্ৰুষার কোন ব্যবস্থাই নেই। ভাবলুম চাকুরি যায় যাবে, ওকে বাচিয়ে তুলব, অন্ততঃ বিনা তদারকে ওকে মরতে দেবো না। সারারাত জেগে রোগীকে দেখাশুনা করলুম একা। সিগ্রিগেশন ক্যাম্পে আরও চারটি রোগী এল—তিনটে সন্ধ্যার মধ্যেই মরে গেল। মেলার ডাক্তার অবিহি নিয়মমত দেখলে। এদের পয়সা নিয়ে যারা বড়-মানুষ, তারা চোখে এসে দেখেও গেল না কাউকে । রাত্রিটা কোন রকমে কাটিয়ে বেলা উঠলে নিমৰ্চাদও মারা গেল। সে এক অতি করুণ ব্যাপার । ওদের দেশের লোক খুজে বার করে নিমৰ্চাদের সৎকারের ব্যবস্থা করা গেল। নিমৰ্চাদের স্ত্রীর দিকে আমি আর চাইতে পারি নে—বটতলায় ধর্ণ দেওয়ার দিন থেকে সেই যে সে উপবাস ক’রে আছে, গোলমালে আর তার খাওয়াই হয়নি। রুক্ষ চুল একমাথা, সেই ধূলিধূসরিত কাপড়—খবর পেয়ে সে ধর্ণ ফেলে বটতলা থেকে উঠে এসেছে—চোখ কেঁদে কেঁদে লাল হয়েছে, যেন পাগলীর মত দৃষ্টি চোখে । এখন আর সে কাদচে না, শুধু কাঠের মত বসে আছে, কথাও বলে না, কোনো দিকে চায় না। মেজবাবুকে বলাতে তিনি ওকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার খরচ দুটাকা মঞ্জুর করলেন। কিন্তু সে আমি যথেষ্ট বললাম ও অনুরোধ করলাম ব'লে। আরও কত যাত্রী এরকম মরে গেল বা তাদের কি ব্যবস্থা হ’ল এ-সব দেখবার দায়িত্ব এদেরই তো। ওঁরাই রইলেন নিৰ্ব্বিকার ভাবে বলে। আমার কাছে কিছু ছিল, যাবার সময় নিমৰ্চাদের স্ত্রীর হাতে দিলুম। চোখের জল রাখতে পারি নে, যখন সে চলে গেল । দিন-দুই পরে রাত্রে বসে আমি ও নবীন মুহুরী হিসেব মেলাচ্চি মেলার দেনাপাওনার। বেশ জ্যোৎস্না রাত, কাক্তিকের সংক্রান্তিতে পরশু মেলা শেষ হয়ে গিয়েছে, বেশ শীত আজ রাত্রে। এমন সময় হঠাৎ আমার কি হ’ল বলতে পারিনে—দেখতে দেখতে নবীন মুহুরী, মেলার আটচালা ঘর, সব যেন মিলিয়ে গেল—আমি যেন এক বিবাহ-সভায় উপস্থিত হয়েচি—অবাক হয়ে চেয়ে দেখি সীতার বিবাহ-সভা। জ্যাঠামশায় কন্যাসম্প্রদান করতে বসেছেন, খুব বেশী লোকজনের নিমন্ত্রণ হয়নি, বরপক্ষেও বরযাত্রী বেশী নেই। দাদাকেও দেখলুম—দাদা বসে ময়দা ঠালচে ।-- আরও সব কি কি...ঘষা কাচের মধ্যে দিয়ে যেন সবটা দেখচি-খানিকট স্পষ্ট, খানিকটা অস্পষ্ট। চমক ভাঙলে দেখি নবীন মুহরী আমার মাথায় জল দিচ্চে। বললে—কি হয়েচে তোমার, মাঝে মাঝে ফিটু হয় নাকি ?