পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/৩৪৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জন্ম ও মৃত্যু ৩২৭ তোমার মায়ের সঙ্গে গেলে, তোমার স্বামী তোমার ওপর কোনো রূঢ় আচরণ না করেন। সে বিষয়ে তুমি নিৰ্ভয়ে থাকতে পার। মেয়েটি মুখ নিচু করে এবারও ঠিক আগের মতে সুরেই বললে—ন আমি যাব না। আমার কেমন একটু রাগ হ’ল—পুলিশে কাজ করে করে একটা বদ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল—কারোর প্রতিবাদ সহ করতে পারতাম না। একটু বিরক্তির মুরে বললুম—এই কষ্টে থাকবে, সেও ভালো ? যাবে না তবুও ? মেয়েটি চুপ করে রইলো। বেশ, না যাবি মরগে যা, তাতে আমার কি ? বললুম—ত হ’লে একটা কাজ কর—না যাও সে তোমার ইচ্ছে। আমাদের কিছু বলবার বা জোর করবার নেই। তুমি একখানা পত্র লেখ তোমার মাকে, যে আমরা তোমাকে যাবার জন্তে অনুরোধ করেছিলুম,—তুমি যেতে রাজী হওনি, আমরা থানার গিয়ে তাকে দেখাব ৷ কাগজ কলম আমরা দিলাম। মেয়েটি মেঝের ওপর বসে চিঠি লিখতে লাগল । ওর স্বগেীর হাত দুটির ওপর সেই সময় ভালো ক’রে চোখ পড়তে দেখি একজোড়া রাঙা কড় ও নোয়া ছাড়া এমন মুত্র মুডৌল হাতে আর কিছু নেই। আরও কষ্ট হ’ল ঘরের মেঝের অবস্থা দেখে । কি বিশ্ৰী সেতসেতে মেঝে, সপসপ করছে ভিজে । সদা-সর্বদা যেন জল উঠছে। এই মেঝের ওপর বিনা খাটে শোয় কি করে—এ আমার বুদ্ধির অতীত। অত্যন্ত মুস্থ লোকও তিন দিন এ রকমের শুধু মেঝের ওপর যদি শুয়ে থাকে, সে নিশ্চয়ই একটা কঠিন অমুখে পড়বে। কথাটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অবাক হ'রে চেয়ে দেখি—মেয়েটি মুখ নিচু করে, পা ছড়িয়ে মেয়েলি ধরনে বা-হাতের কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে একদিকে কত হয়ে বসে চিঠি লিখছে আর তার ডাগর চোখ দুটি বয়ে টস্টস্ করে জল পড়ছে, দু এক ফোট জল চিঠির ওপরও পড়ল । পুলিশের চাকুরিতে মন বেশ একটু কঠিন হয়ে গিয়েছিল বটে, তবু মেয়েটির নিঃশৰ কান্না দেখে, ওর সংসারের এই নগ্ন দারিদ্র্য, নিরাভরণ ওই হাত দু'টি, এই সেতসেতে ঘরের মেঝে, ভাঙ্গা আয়নাখানা, ওই ধুকড়ি লেপ কাথা দেখে, তার ওপর ওর গাজাখের মুখ স্বামীর কথা মনে হয়ে—না মশাই আপনার বললে বিশ্বাস করবেন না-মুরট নরম করেই বললুম—এই তো, যাকে চিঠি লিখতেই - মার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। তবে কেন চল না, র্তার সঙ্গে ? আমার সহানুভূতির স্বর বোধ হয় ওর হৃদয় স্পর্শ করলে, বললে, সেখানে এর চেয়েও কষ্ট। ওর সেই দৃষ্টিতে হতাশা, ঔদাসীপ্ত, মরীয়াভাব—সব একসঙ্গে জড়ানো। অবাক হয়ে বললুম—এর চেয়েও কষ্ট ! এর চেয়ে আর কি কষ্ট থাকতে পারে ? মেয়েট শাস্ত, স্থির সুরে বললে--আপনি সব কথা জানেন না, বললুম যে আরও অনেক কথা আছে এর মধ্যে ! সে সব কথা বলতে চাইনে । মকে আমার প্রণাম জানাবেন আর বলবেন, তোমার মেয়ে মরেচে আর তার খোজ কোরো না—