পাতা:বিষবৃক্ষ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭৬ বিষবৃক্ষ দেখিল, স্বার মুক্ত। কুন্দ সাহসে ভর করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করিল। এবং উষ্ঠানপ্রান্তে ধীরে ধীরে আসিয়া এক বকুলবৃক্ষের অন্তরালে দাড়াইল । উষ্ঠানটি ঘন বৃক্ষলতাগুল্মরাজিপরিবৃত। বৃক্ষশ্রেণীমধ্যে প্রস্তররচিত সুন্দর পথ, স্থানে স্থানে শ্বেত, রক্ত, নীল, পীতবর্ণ বহু কুমুমরাশিতে বৃক্ষাদি মণ্ডিত হইয়া রহিয়াছে— তত্ত্বপরি প্রভাতমধুলুব্ধ মক্ষিকাসকল দলে দলে ভ্ৰমিতেছে, বসিতেছে, উড়িতেছে—গুন গুৰু শব্দ করিতেছে। এবং মনুষের চরিত্রের অনুকরণ করিয়া একটা একটা বিশেষ মধুযুক্ত ফুলের উপর পালে পালে ঝুকিতেছে । বিচিত্রবর্ণ অতি ক্ষুদ্র পক্ষিগণ প্রফুটিত পুষ্পগুচ্ছোপরি বৃক্ষফলবৎ আরোহণ করিয়া পুষ্পরসপান করিতেছে, কাহারও কণ্ঠ হইতে সপ্তস্বর-সংমিলিত ধ্বনি নির্গত হইতেছে। প্রভাত বায়ুর মন্দ হিল্লোলে পুষ্পভারাবনত ক্ষুদ্র শাখা চুলিতেছে—পুষ্পহীন শাখাসকল তুলিতেছে না ; কেন না, তাহারা নম্র নহে। কোকিল মহাশয় বকুলের ঝোপের মধ্যে কালবৰ্ণ লুকাইয়া গলা-বাজিতে সকলকে জিতিতেছেন । - উদ্যানমধ্যস্থলে, একটি শ্বেতপ্রস্তরনিৰ্ম্মিত লতামণ্ডপ । তাহ অবলম্বন করিয়া নানাবিধ লতা পুষ্পধারণ করিয়া রহিয়াছে এবং তাহার ধারে মৃত্তিকাধারে রোপিত সপুষ্প গুল্ম সকল শ্রেণীবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। কুন্দনন্দিনী বকুলাস্তরাল্প হইতে উদ্যানমধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া নগেন্দ্রের দীর্ঘায়ত দেবমূৰ্ত্তি দেখিতে পাইল না। লতামণ্ডপ মধ্যে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল যে, তাহার প্রস্তরনিৰ্ম্মিত স্নিগ্ধ হৰ্ম্ম্যোপরি কেহ শয়ন করিয়া রহিয়াছে, কুন্দনন্দিনীর বোধ হইল, সেই গেন্দ্র। ভাল করিয়া দেখিবার জন্য সে ধীরে ধীরে বৃক্ষের অন্তরালে আস্তরালে থাকিয়া অগ্রবৰ্ত্তিনী হইতে লাগিল । তুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময়ে লতামণ্ডপস্থ ব্যক্তি গাত্ৰোখান করিয়া বাহির হইল । হতভাগিনী কুন্দ দেখিল যে, সে নগেন্দ্র নহে, সূৰ্য্যমুখী । কুন্দ তখন ভীত হইয়া এক প্রস্ফুটিত কামিনীর অন্তরালে দাড়াইল। ভয়ে অগ্রসর হইতে পারিল না—পশ্চাদপস্থতও হইতে পারিল না । দেখিতে লাগিল, সূৰ্য্যমুখী উদ্যানমধ্যে পুষ্পচয়ন করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। যেখানে কুন্দ লুকাইয়া আছে, সূৰ্য্যমুখী ক্রমে সেই দিকে আসিতে লাগিলেন। কুন্দ দেখিল যে, ধরা পড়িলাম। শেষে সূৰ্য্যমুখী কুন্দকে দেখিতে পাইলেন। দূর হইতে চিনিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কে গা” । কুন্দ ভয়ে নীরব হইয়া রহিল—পা সরিল না। সূৰ্য্যমুখী তখন নিকটে আসিলেন— দেখিলেন–চিনিলেন যে, কুন্দ। বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “কে, কুন্দ না কি ?”