পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৩৭

না, কাহাকেও দেখিতে পাইল না;—কেবল সেই বায়ুহীন, শব্দহীন দিনরাত্রিহীন, জনশূন্য তারাশূন্য দিক্‌দিগন্তশূন্য মহান্ধকারের মধ্যে দাঁড়াইয়া মাঝে মাঝে চারিদিক্‌ হইতে ক্রন্দন শুনিতে পাইল, কেবল বাতাস দূর হইতে করিতে লাগিল হূ—হূ!

 সমস্ত রাত্রি অনিদ্রায় কাটিয়া গেল। পর দিন বিভা কারাগারে উদয়াদিত্যের নিকট যাইবার নিমিত্ত অনেক চেষ্টা করিল, সেখানে তাহার যাওয়া নিষেধ। সমস্ত দিন ধরিয়া অনেক কাঁদাকাটি করিল। এমন কি স্বয়ং প্রতাপাদিত্যের কাছে গেল। বিভা তাঁহার পা জড়াইয়া ধরিল। অনেক কষ্টে সম্মতি পাইল। পরদিন প্রভাত হইতে না হইতেই বিভা শয্যা হইতে উঠিয়া কারাগৃহে প্রবেশ করিল। গিয়া দেখিল, উদয়াদিত্য বিছানায় শােন নাই। ভূমিতলে বসিয়া, বাতায়নের উপরে মাথা দিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। দেখিয়া বিভার প্রাণ যেন বুক ফাটিয়া কাঁদিয়া উঠিতে চাহিল। অনেক কষ্টে রােদন সম্বরণ করিল। অতি ধীরে নিঃশব্দে উদয়াদিত্যের কাছে গিয়া বসিল। ক্রমে প্রভাত পরিষ্কার হইয়া আসিল। নিকটের বন হইতে পাখীরা গাহিয়া উঠিল। পাশের রাজপথ হইতে পান্থেরা গান গাহিয়া উঠিল। দুই একটি রাত্রি জাগরণে ক্লান্ত প্রহরী আলো দেখিয়া মৃদুস্বরে গান গাহিতে লাগিল। নিকটস্থ মন্দির হইতে শাঁখ ঘণ্টার শব্দ উঠিল। উদয়াদিত্য সহসা চমকিয়া জাগিয়া উঠিলেন। বিভাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিলেন, “একি বিভা, এত সকালে যে?” ঘরের চারিদিকে চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন—“এ কি—আমি কোথায়?” মুহূর্ত্তের মধ্যে মনে পড়িল, তিনি কোথায়! বিভার দিকে চাহিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আঃ—বিভা, তুই আসিয়াছিস্? কাল তােকে সমস্ত দিন দেখি নাই, মনে হইয়াছিল, বুঝি তােদের আর দেখিতে পাইব না।”

 বিভা উদয়াদিত্যের কাছে আসিয়া চোখ মুছিয়া কহিল, “দাদা, মাটিতে বসিয়া কেন? খাটে বিছানা পাতা রহিয়াছে। দেখিয়া বােধ হইতেছে,