পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৫৬
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

একবার মনে হইল—“বিভার কি ক্রমেই বিরক্তি ধরিতেছে? এই নিরানন্দ কারাগারের মধ্যে এক বিষণ্ণ অন্ধকার মুর্ত্তির সেবা করিতে আর কি তাহার ভাল লাগিতেছে না? আমাকে কি ক্রমেই সে তাহার সুখের বাধা— তাহার সংসার-পথের কণ্টক বলিয়া দেখিবে? আজ দেরি করিয়া আসিয়াছে—কাল হয় ত আরো দেরি করিয়া আসিবে—তাহার পরে এক দিন হয় ত সমস্ত দিন বসিয়া আছি কখন্ বিভা আসিবে—বিকাল হইল—সন্ধ্যা হইল—রাত্রি হইল, বিভা আর আসিল না!—তাহার পর হইতে আর হয় ত বিভা আসিবে না।” উদয়াদিত্যের মনে যতই এই কথা উদয় হইতে লাগিল, ততই তাঁহার মনটা হা-হা করিতে লাগিল— তাঁহার কল্পনা-রাজ্যের চারিদিক কি ভয়ানক শূন্যময় দেখিতে লাগিলেন। এক দিন আসিবে যে দিন বিভা তাঁহাকে স্নেহশূন্য নয়নে তাহার সুখের কণ্টক বলিয়া দেখিবে—সেই অতি দূর কল্পনার আভাস মাত্র লাগিয়া তাঁহার হৃদয় একবারে ব্যাকুল হইয়া উঠিল। একবার মনে করিতেছেন “আমি কি ভয়ানক স্বার্থপর! আমি বিভাকে ভালবাসি বলিয়া তাহার যে ঘােরতর শত্রুতা করিতেছি, কোন শত্রুও বােধ করি এমন পারে না।” বার বার করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছেন আর বিভার উপর নির্ভর করিবেন না—কিন্তু যখনি কল্পনা করিতেন তিনি বিভাকে হারাইয়াছেন, তখনি তাঁহার মনে সে বল চলিয়া যাইতেছে, তখনি তিনি অকুল পাথারে পড়িয়া যাইতেছেন—মরণাপন্ন মজ্জমান ব্যক্তির মত বিভার কাল্পনিক মূর্ত্তিকে আকুল ভাবে আঁকড়িয়া ধরিতেছেন।

 এমন সময় বহির্দ্দেশে সহসা “আগুন—আগুন” বলিয়া এক ঘােরতর কোলাহল উঠিল। উদয়াদিত্যের বুক কাঁপিয়া উঠিল—বাহিরে শত শত কণ্ঠরােল একত্রে উঠিল, সহসা নানা কষ্টের নানাবিধ চীৎকার সহিত আকাশে শত লােকের দ্রুত পদশব্দ শুনা গেল। উদয়াদিত্য বুঝিলেন, প্রাসাদের কাছাকাছি কোথাও আগুন লাগিয়াছে। অনেকক্ষণ ধরিয়া