পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

দেখিতে আসিতেন। অভিমান নাই, কিছুই নাই। জিজ্ঞাসাও করিতেন না, কেন যাই নাই। আমাদের দেখিতেন, আমােদ উল্লাস করিতেন ও চলিয়া যাইতেন।”

 উদয়াদিত্য ঈষৎ হাস্য করিয়া অতিশয় মৃদু কোমল প্রেমে তাঁহার বড় বড় চোখ দুটি প্লাবিত করিয়া সুরমার মুখের দিকে চাহিলেন। সুরমা বুঝিল, এইবার কি কথা আসিতেছে। মুখ নত হইয়া আসিল; ঈষৎ চঞ্চল হইয়া পড়িল। যুবরাজ দুই হস্তে তাহার দুই কপােল ধরিয়া নত মুখ খানি তুলিয়া ধরিলেন; অধিকতর নিকটে গিয়া বসিলেন; মুখখানি নিজের স্কন্ধে ধীরে ধীরে রাখিলেন। কটিদেশ বামহস্তে বেষ্টন করিয়া ধরিলেন ও গভীর প্রশান্ত প্রেমে তাহার কপােল চুম্বন করিয়া বলিলেন—

 “তারপর কি হইল, সুরমা, বল দেখি? এই বুদ্ধিতে দীপ্যমান, স্নেহ প্রেমে কোমল, হাস্যে উজ্জ্বল ও প্রশান্ত ভাবে বিমল মুখখানি কোথা হইতে উদয় হইল? আমার সে গভীর অন্ধকার ভাঙিবে আশা ছিল কি? তুমি আমার ঊষা, আমার আলো, আমার আশা, কি মায়ামন্ত্রে সে আঁধার দূর করিলে?” যুবরাজ বারবার সুরমার মুখচুম্বন করিলেন। সুরমা কিছুই কথা কহিল না, আনন্দে তাহার চোখ জলে পূরিয়া আসিল; যুবরাজ কহিলেন,—

 “এতদিনের পরে আমি যথার্থ আশ্রয় পাইলাম। তােমার কাছে প্রথম শুনিলাম যে আমি নির্ব্বোধ নই, তাহাই বিশ্বাস করিলাম, তাহাই বুঝিতে পারিলাম। তােমারি কাছে শিখিলাম বুদ্ধি অন্ধকারময় ক্ষুদ্র গলির মত বাঁকাচোরা উচুনিচু নহে, রাজপথের ন্যায় সরল সমতল, প্রশস্ত। পূর্ব্বে আমি আপনাকে ঘৃণা করিতাম, আপনাকে অবহেলা করিতাম। কোন কাজ করিতে সাহস করিতাম না। মন যদি বলিত, ইহাই ঠিক, আত্ম-সংশয়ী সংস্কার বলিত, উহা ঠিক না হইতেও পারে।