পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

যে যেরূপ ব্যবহার করিত তাহাই সহিয়া থাকিতাম, নিজে কিছু ভাবিতে চেষ্টা করিতাম না। এতদিনের পরে আমার মনে হইল, আমি কিছু, আমি কেহ। এতদিন আমি অগোচর ছিলাম, তুমি আমাকে বাহির করিয়াছ, সুরমা, তুমি আমাকে আবিষ্কার করিয়াছ, এখন আমার মন যাহা ভাল বলে, তৎক্ষণাৎ তাহা আমি সাধন করিতে চাই। তােমার উপর আমার এমন বিশ্বাস আছে যে, তুমি যখন আমাকে বিশ্বাস কর, তখন আমিও আমাকে নির্ভয়ে বিশ্বাস করিতে পারি। ওই সুকুমার শরীরে এত বল কোথায় ছিল যাহাতে আমাকেও তুমি বলীয়ান্ করিয়া তুলিয়াছ?”

 কিন্তু অপরিসীম নির্ভরের ভাবে সুরমা স্বামীর বক্ষ বেষ্টন করিয়া ধরিল। কি সম্পূর্ণ আত্ম-বিসর্জ্জী দৃষ্টিতে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল! তাহার চোখ কহিল “আমার আর কিছুই নাই কেবল তুমি আছ, তাই আমার সব আছে!”

 বাল্যকাল হইতে উদয়াদিত্য আত্মীয় স্বজনের উপেক্ষা সহিয়া আসিতেছেন, মাঝে মাঝে এক এক দিন নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে সুরমার নিকট সেই শতবার কথিত পুরাণাে জীবনকাহিনী খণ্ডে খণ্ডে সোপানে সােপানে আলোচনা করিতে তাঁহার বড় ভাল লাগে।

 উদয়াদিত্য কহিলেন, “এমন করিয়া আর কত দিন চলিবে সুরমা? এদিকে রাজসভায় সভাসদ্‌গণ কেমন এক প্রকার কৃপাদৃষ্টিতে আমার প্রতি চায়, ওদিকে অন্তঃপুরে মা তােমাকে লাঞ্ছনা করিতেছেন; দাস দাসীরা পর্য্যন্ত তােমাকে তেমন মানে না। আমি কাহাকেও ভাল করিয়া কিছু বলিতে পারি না, চুপ করিয়া থাকি, সহ্য করিয়া যাই। তােমার তেজস্বী স্বভাব, কিন্তু তুমিও নীরবে সহিয়া যাও। যখন তােমাকে সুখী করিতে পারিলাম না, আমা হইতে তােমাকে কেবল অপমান আর কষ্টই সহ্য করিতে হইল, তখন আমাদের এ বিবাহ না হইলেই ভাল ছিল।”

 সুরমা,—“সে কি কথা নাথ? এই সময়েই ত সুরমাকে আবশ্যক।