পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

হইতে বিষ্ণুপ্রিয়ার ঝি বলিল — কোথা যাচ্ছ মা হনহন করে? যেও নি, গিন্নীমা ঘুমুচ্ছে,— এমনি ধারা সময় কারো বাড়ি কি আসতে আছে যাও মা এখন, বিকেলে এসো।

 শ্যামা বলিল — দিদির হাসি শুনলাম যে কি? জেগেই আছেন।

 ঝি বলিল — হাসি শুনবে নি তো কি কান্না শুনবে মা? ওপরে এখন যেতে মানা, যেও না।

 শ্যামা অগত্যা বাড়ি ফিরিয়া গেল। ভাবিল, পাঁচটার সময় আর একবার আসিয়া বলিয়া দেখিবে, উপায় কি, বিধানের তো স্কুলে না গেলে চলিবে না? বাড়ি ফিরিতেই বিধান বলিল, কোথা গিয়েছিলে মা?

 — ওই ওদের বাড়ি।

 কাদের বাড়ি, বিধান জিজ্ঞাসা করিল না। ছেলেবেলা হইতে শ্যামা এই ছেলেটিকে অদ্ভুত বলিয়া জানে, রহস্যময় বলিয়া জানে, ছ বছর বয়সে এই ছেলে তাহার উদাস নয়নে দুর্বোধ্য স্বপ্ন দেখিত, ডাকিলে সাড়া মিলিত না। কথা কহিয়া, খেলা দিয়া না যাইত হাসানো, না চলিত ভোলানো। আর নিষ্ঠুর? সময় সময় শ্যামার মনে হইত, ছেলে যেন পাষাণ,— রক্তমাংসে তৈরি বুক ওর নাই। তারপর ওর প্রকৃতির কত বিচিত্র দিক স্পষ্ট হইয়া উঠিয়া আবার ওর মধ্যেই কোথায় লুকাইয়া গিয়াছে,— একটির পর একটি দুর্বোধ্যতা, রাশি রাশি মুখোশ পরিয়া যেন জন্মিয়াছিল, একে একে খুলিয়া চলিয়াছে, ওর আসল পরিচয় আজও শ্যামা চিনিল না। কত সময় সে ভয় পাইয়া ভাবিয়াছে, বাপের পাগলামিই কি ছেলের মধ্যে প্রবলতর হইয়া দেখা দিতেছে, ও কি একদিন পাগল হইয়া যাইবে? অত কি ভাবে ও? সময় সময় জননীর উন্মাদ ভালবাসাকে কেমন করিয়া দু পায়ে মাড়াইয়া চলে অতটুকু ছেলে! বিধানকে মনে মনে শ্যামা ভয় করে। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি যাওয়ার কথা ওকে বলিতে পারিল না।

 বিধান বলিল — ওদের গাড়িতে আমি আর স্কুলে যাব না মা, কখখনো কোনোদিন যাব না।

 — ওরা যদি আদর করে ডাকতে আসে?

 — ডাকতে এলে মেরে তাড়িয়ে দেব।

 শুনিয়া শ্যামারও মনে হইল, এই তো ঠিক, অত অপমান তাহারা সহিবে

১০৭