পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাণিক গ্রন্থাবলী

দেখছ না মামা? ওর মা আমার কাছে অনেকদিন কাজ করেছিল তাই রাখা, নইলে মাইনে দিয়ে অমন ঝি কে রাখে?

 খাওয়া দাওয়া শেষ হইতে দুটো বাজিল। শ্যামা সবে পান সাজিয়া মুখে দিয়াছে, শীতল ফিরিয়া আসিল। শ্যামা অবাক হইয়া বলিল — এত শিগগির ফিরলে যে?

 — মামার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলব, প্রেসে কাজকর্মও নেই—

 বেশ করেছ। যেমন করে অফিসে চলে গেলে, মামা না জানি কি ভেবেছিল।

 শীতল ইতস্তত করে, কি যেন সে বলিবে মনে করিয়াছে। সে একটা পান খায়। শ্যামার মুখের দিকে চাহিয়া মনে মনে কি সব হিসাব করে। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল — মামা কদিন থাকবেন এখন, না?

 শ্যামা বলিল — কদিন কেন? বরাবর থাকবেন, আমরা থাকতে বুড়োবয়সে হোটেলের ভাত খেয়ে মরবেন কি জন্যে?

 — আমিও তাই বলছিলাম!— পয়সা-কড়ি কিছু করেছেন মনে হয়, এ্যাঁ?

 — মনে তো হয়, এখন আমাদের অদেষ্ট!

 মামা একটা ঘুম দিয়া উঠিলে বিকালে তাহারা চারিদিকে ঘেরিয়া বসিয়া গল্প শুনিতে লাগিল, শহর গ্রাম অরণ্য পর্বতের গল্প, রাজা-মহারাজা সাধু-সন্ন্যাসী চোরডাকাতের গল্প, রোমাঞ্চকর বিপদ-আপদের গল্প। মামা কি কম দেশ ঘুরিয়াছে, কম মানুষের সঙ্গে মিশিয়াছে! সুদূর একটা তীর্থের নাম কর, যার নামটি মাত্র শ্যামা ও শীতল শুনিয়াছে, যেমন রামেশ্বর সেতুবন্ধ, নাসিক, বদরীনাথ — মামা সঙ্গে সঙ্গে পথের বর্ণনা দেয়, তীর্থের বর্ণনা দেয়, সব যেন রূপ ধরিয়া চোখের সামনে ফুটিয়া ওঠে। সেই বিধবা সঙ্গিনীটি কতকাল মামার সঙ্গে ছিল, কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারে না, মামার যাযাবর জীবনের ইতিবৃত্ত শুনিয়া কিন্তু মনে হয়, চিরকাল সে দেশে দেশে ঘুরিয়াছে একা, সাথী যদি কখনো পাওয়া গিয়া থাকে, সে পথের সাথী, পুরুষ। শ্যামা একবার সুকৌশলে জিজ্ঞাসা করে, গ্রাম হইতে বাহির হইয়া প্রথমে মামা কোথায় গিয়াছিল, মামা সোজাসুজি জবাব দেয়— কাশী — কাশীতে ছিলাম পাঁচ-ছটা মাস, ভুলে টুলে গিয়েছি সে সব বাপু, সে কি আজকের কথা!

 শ্যামা বলে — এক একা ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগত মামা?

 মামা বলে — একা ঘুরেই তো সুখ রে, ভাবনা নেই, চিন্তা নেই, যখন যেখানে খুশি পড়ে থাক, যেখানে খুশি চলে যাও, কারো তোয়াক্কা নেই, জুটলো খেলে না জুটলো

৭৮