পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাকাবার চেষ্টা আছে। বইয়ের ভূমিকায় লেখক যা-ই বলুন, যে কোনো সতর্ক পাঠকই বলবেন প্রতিবিম্বে কমিউনিস্ট পার্টিই মানিকবাবুর লক্ষ্য।

 সহরতলী-প্রতিবিম্বের মত উপন্যাসের ঘুরপাক খেতে খেতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানস প্রতিক্রিয়া বক্রজটিল মনুষ্যভাবনা থেকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায় পৌঁছেছিল।

 এই উপন্যাসে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরের যে ছবি আছে তা তারকের মনের আয়নায় প্রতিবিম্বিত। এবং সে-আয়না কারখানায় তৈরি নিখুঁত বস্তু নয় বলেই কিঞ্চিৎ চিড়্‌ ধরা। সম্ভবত তারকে লেখকের ভেতরের অংশও কিছু স্থানলাভ করেছিল। ঔপন্যাসিকের তরফ থেকে কোনো কৈফিয়ৎ অবান্তর। কারণ এ-চিত্র ডকুমেণ্টারি নয়। রবীন্দ্রনাথের সন্দীপের শুদ্ধ পাপোদ্বুদ্ধ মনুষ্যধর্মে সেকালের স্বদেশী আন্দোলনের ইতিহাস খোঁজা চলবে না, তেমনি তারকের মনের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন কমিউনিস্ট পার্টির তথ্যনিষ্ঠ পরিচয় নয়।


 পাটির কর্মীদের যৌথবাস যৌনমুক্তি ও আদর্শবাদের উচ্চকণ্ঠ ভেদ করে ঈষৎ ব্যঙ্গের রঙ্‌ ফুটে বেরিয়েছে। সে-ব্যঙ্গের রঙ্‌ ছাপিয়ে কয়েকটি মানুষ সঙ্কীর্ণ অবকাশে দুই একটি রেখার টানেই পূর্ণমুখশ্রী। বিশেষত সরোজিনী আর সীতানাথ। সরোজিনীর চেহারায় পুঞ্জ পুঞ্জ বিষাদ। সে কিন্তু এই বিষাদকে তার রূপের ছলনা বলে মনে করে। জননীর ন্যায় তার নেত্রীত্ব - সহনশীল গম্ভীর শান্ত। সীতানাথের অধীর এবং সংযমোর্ধ্ব তারুণ্যে, সরোজিনীর নিরুত্তাপ প্রত্যাখ্যানে, তারকের বীরত্বে যে নাটক জমে উঠেছিল গোটা উপন্যাসে তা-ই শীর্ষ। নাটক করার দায়িত্ব গ্রামের তারকের। সহরের অন্যেরা মূর্তিমান অনাটক। তারা কি দগ্ধচিত্ত অথবা সবটাই উর্ধ্বগতি-কামনার ভান? এ-জাতীয় নাটক করায় মানিকবাবুর আগ্রহ কম। এখানেও তা শুধু উপলক্ষ। লক্ষ হল চারপাশের কয়েকটা মানুষ যাদের সূক্ষ্ম যৌনবোধে, ছলনায় - অপরকে ছলনার চেয়ে আরও বেশি নিজেকে ছলনায় দুশ্ছেদ্য-গ্রন্থি মনস্তত্বের জাল বিস্তৃত। সীতানাথের প্রতি সরোজিনীর মন যতটা নিরুত্তাপ ততটা নির্দোষ কি? সীতুর বালকভাব কি প্রত্যাখ্যাত-প্রহৃত হয়ে কোনো গোপন তৃপ্তি পায় নি? তারকের ঔদ্ধত্য কি নির্মোহ সমাজস্বাস্থ্যের বাহনমাত্র? ছাদে দাঁড়িয়ে সরোজিনীকে পরীক্ষা করে যে প্রশ্ন সে করেছিল তা কি কোথাও কামনায় একটু ভেজা ছিল না?

১১