bang labOOKS. in SV8 মানিক রচনাসমগ্ৰ যতীন মামা হাে হাে করে হেসে উঠলেন। মামি বললে, দ্যাখে তো ভাগনের কাণ্ড ! যতীন মামা বললেন, ভক্তি হয়েছে গো! সকালসন্ধ্যা স্বামীকে প্ৰণাম করো জেনে শ্রদ্ধা হয়েছে ভাগনের । কী যে বল!—বলে মামি পলায়ন করল। বারান্দা থেকে বলে গেল, আমি রান্না করতে গেলাম। যতীন মামা বললেন, এইবার বঁশি শোনো। আমি বললাম, থাকগে, কােজ নেই মামা। শেষে আবার রক্ত পড়তে আরম্ভ করবে। যতীন মামা বললেন, তুমিও শেষে ঘ্যানঘান প্যানপ্যান আরম্ভ করলে ভাগনে? রক্ত পড়বে তো হয়েছে কী? তুমি শুনলেও আমি বাজ্ঞ’ব, না শুনলেও বাজাব। খুশি হয় রান্নাঘরে মমির কাছে বসে কানে আঙুল দিয়ে থাকো গে। কাঠের ব্যাকসোটা খুলে বাঁশির কাঠের কেন্সটা বার করলেন। বললেন, বারান্দায় চলো, ঘরে বড়ো শব্দ হয়। নিজেই বারান্দায় মাদুরটা তুলে এনে বিছিয়ে নিলেন। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বাঁশিটা মুখে তুললেন। হঠাৎ আমার মনে হল আমার ভেতরে যেন একটা উন্মাদ একটা খ্যাপা উদাসীন ঘুমিয়ে ছিল আজ বাঁশির সুরের নাড়া জেগে উঠল। বঁশির সুর এসে লাগে কানে কিন্তু আমার মনে হল বুকের তলেও যেন সাডা পৌছেছে। অতি তীব্র বেদনার মধুরতম আত্মপ্রকাশ কেবল বুকের মাঝে গিয়ে পৌঁছায়নি, বাইরের এই ঘরদেরকেও যেন স্পর্শ দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছে, আর আকাশকে বাতাসকে মৃদুভাবে স্পর্শ করতে করতে যেন দূরে, বহুদূরে, যেখানে গোটা কয়েক তারা ফুটে উঠেছে দেখতে পাচ্ছি, সেইখানে স্বপ্নের মায়ার মধ্যে লয় পাচ্ছে। অন্তরে ব্যথা বোধ করে আনন্দ পাবাব যতগুলি অনুভূতি আছে বাঁশির সুর যেন তাদের সঙ্গে কোলাকুলি আরম্ভ করেছে। বঁশি শুনেছি ঢের। বিশ্বাস হয়নি এই বাঁশি বাজিয়ে একজন একদিন এক কিশোরীর কুল মান লজ্জা ভয় সব ভুলিয়ে দিয়েছিল, যমুনাতে উজান বইয়েছিল। আজ মনে হল, আমার যতীন মামার বাঁশিতে সমগ্ৰ প্ৰাণ যদি আচমকা জেগে উঠে নিরর্থক এমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তবে সেই বিশ্ববাঁশির বাদকের পক্ষে ওই দুটি কাজ আর এমন কী কঠিন! দেখি, মামি কখন এসে নিঃশব্দে ওদিকের বারান্দায় বসে পড়েছে। খুব সম্ভব ওই ঘরটাই রান্নাঘর, কিংবা বান্নাঘরে যাবার পথ ওই ঘরের ভেতব দিয়ে। যতীন মামাব দিকে চেয়ে দেখলাম, খুব সম্ভব সংজ্ঞা নেই। এ যেন সুরের আত্মভোলা সাধক, সমাধি পেয়ে গেছে। কতক্ষণ বঁশি চলেছিল ঠিক মনে নেই, বোধ হয় ঘণ্টা দেড়েক হবে। হঠাৎ এক সময়ে বঁশি থামিয়ে যতীন মামা ভয়ানক কাশতে আরম্ভ করলেন। বারান্দার ক্ষীণ আলোতেও বুঝতে পারলাম, মামার মুখ চােখ অস্বাভাবিক রকম লাল হয়ে উঠেছে। অতসী মামি বোধ হয় প্রস্তুত ছিল, জল আর পাখা নিয়ে ছুটে এল। খানিকটা রক্ত তুলে মামির শুশুযায় যতীন মামা অনেকটা সুস্থ হলেন। মাদুরের ওপর একটা বালিশ পেতে মামি তাকে শুইযে দিল। পাখা নেড়ে নীরবে হাওয়া করতে লাগল। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আজ আসি যতীন মামা। মামা কিছু বলবার আগেই মামি বললে, তুমি এখন কথা কয়ো না। ভাগনের বাড়িতে ভাববে, আজ থাক, আর একদিন এসে খেয়ে যাবে এখন। চলো আমি দরজা দিয়ে আসছি।