পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে >b's সম্বন্ধেও স্বাধীনত চাই । দেশ আমার কাছে অত্যস্ত বাস্তব, সেইজষ্ঠে আমি কোনো নীতিকথার ধোয়ায় তাকে এতটুকু আড়াল করে দেখতে পারব না—আমি আমার কাছে অত্যন্ত বাস্তব, তুমি আমার কাছে অত্যস্ত বাস্তব, সেইজন্তে মাঝখানে কেবল কতকগুলো কথা ছড়িয়ে মানুষের কাছে মানুষকে দুর্গম দুর্বোধ করে তোলবার ব্যবসায় আমি একটুও পছন্দ করি নে। আমার মনে ছিল যে-লোক ঘুমোতে ঘুমোতে চলছে তাকে হঠাৎ চমকিয়ে দেওয়া কিছু নয়। কিন্তু আমার স্বভাবটা যে দুর্দাম, ধীরে স্বন্থে চলা আমার চাল নয় । জানি যে-কথা সেদিন বললুম তার ভঙ্গিটা তার স্বরট। বড়ো সাহসিক—জানি এ-রকম কথার প্রথম আঘাত কিছু দুঃসহ–কিন্তু মেয়েদের কাছে সাহসিকেরই জয় । পুরুষরা ভালোবাসে ধোয়াকে, আর মেয়ের ভালোবাসে বস্বকে—সেই জন্যেই পুরুষ পুজো করতে ছোটে তার নিজের আইডিয়ার অবতারকে আর মেয়েরা তাদের সমস্ত অৰ্ঘ্য এনে হাজির করে প্রবলের পায়ের তলায় । আমাদের কথাটা ঠিক যখন গরম হয়ে উঠতে চলেছে এমন সময় আমাদের ঘরের মধ্যে নিখিলের ছেলেবেলাকার মাস্টার চন্দ্রনাথবাবু এসে উপস্থিত । মোটের উপরে পৃথিবী জায়গাটা বেশ ভালোই ছিল কিন্তু এই সব মাস্টারমশায়দের উৎপাতে এখান থেকে ৰাস ওঠাতে ইচ্ছে করে । নিখিলেশের মতো মানুষ মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই সংসারটাকে ইস্কুল বানিয়ে রেখে দিতে চায় । বয়স হল তবু ইস্কুল পিছন-পিছন চলল, সংসারে প্রবেশ করলে সেখানেও ইস্কুল এসে ঢুকল । উচিত, মরবার সময়ে ইস্কুলমাস্টারটিকে সহমরণে টেনে নিয়ে যাওয়া । সেদিন আমাদের আলাপের মাঝখানে অসময়ে সেই মূর্তিমান ইস্কুল এসে হাজির । আমাদের সকলেরই ধাতের মধ্যে এক জায়গায় একটা ছাত্র বাসা করে আছে বোধ করি। আমি যে এ-হেন চুবুৰ্ত্ত আমিও কেমন থমকে গেলুম। আর আমাদের মক্ষী,—তার মুখ দেখেই মনে হল সে এক মুহূর্তেই ক্লাসের সব-চেয়ে ভালো ছাত্রী হয়ে একেৰারে প্রথম সারে গম্ভীর হয়ে বসে গেল—তার হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল পৃথিবীতে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার একটা দায় আছে । এক-একটা মাস্থ্য রেলের পয়েণ্টসম্যানের মতো পথের ধারে বসে থাকে, তারা ভাবনার গাড়িকে খামক এক লাইন থেকে আর-এক লাইনে চালান করে দেয়। চন্দ্রনাথবাবু ঘরে ঢুকেই সংকুচিত হয়ে ফিরে বাবার চেষ্টা করছিলেন—মাপ করবেন আমি—কথাটা শেষ করতে না-করতেই মঙ্গী তার পায়ের কাছে নত হয়ে