পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে Y?& মক্ষী একখানা বই খুলে তার পাতা ওলটাতে লাগল। আমি বললুম, আপনি যদি রাগ করেন আমি ওর ফাকটা কোনোরকম করে ভরিয়ে দেব । আজ ফাকটা ভরিয়েছি। আমার এ ছবিটা অল্পবয়সের—তখনকার মুখটা কাচাকঁচি, মনটাও সেইরকম ছিল । তখনও ইহকাল-পরকালের অনেক জিনিস বিশ্বাস করতুম। বিশ্বাসে ঠকায় বটে কিন্তু ওর একটা মস্ত গুণ এই, ওতে মনের উপর একটা লাবণ্য দেয় । নিখিলের ছবির পাশে আমার ছবি রইল—আমরা দুই বন্ধু। নিখিলেশের আত্মকথা আগে কোনোদিন নিজের কথা ভাবি নি। এখন প্রায় মাঝে-মাঝে নিজেকে বাইরে থেকে দেখি । বিমল আমাকে কেমন চোখে দেখে সেইটে আমি দেখবার চেষ্টা করি । বড়ো গম্ভীর—সব জিনিসকে বড়ো বেশি গুরুতর করে দেখা আমার অভ্যাস । আর কিছু না, জীবনটাকে কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার চেয়ে হেসে উড়িয়ে দেওয়াই ভালো। তাই করেই তো চলছে। সমস্ত জগতে আজ যত দুঃখ ঘরে-বাইরে ছড়িয়ে আছে, তাকে তো আমরা মনে-মনে ছায়ার মতো মায়ার মতো উড়িয়ে দিয়ে তবেই অনায়াসে নাচ্ছি খাচ্ছি—তাকে যদি এক মুহূর্ত সত্য বলে ধরে রেখে দেখতে পারতুম তাহলে কি মুখে অল্প রুচত, না চোখে ঘুম থাকত ? কেবল নিজেকেই সেই সমস্ত উড়ে-যাওয়া ভেসে-যাওয়ার দলে দেখতে পারি নে। মনে করি কেবল আমারই দুঃখ জগতের বুকে অনন্তকালের বোঝা হয়ে হয়ে জমে উঠছে । তাই এত গম্ভীর—তাই নিজের দিকে তাকালে দুই চক্ষের জলে বক্ষ ভেসে যায় । ওরে হতভাগা, একবার জগতের সদরে দাড়িয়ে সমস্তর সঙ্গে আপনাকে মিলিয়ে দেখ, না। সেখানে যুগযুগাস্তের মহামেলায় লক্ষকোটি লোকের ভিড়ে বিমল তোমার কে ? সে তোমার স্ত্রী ! কাকে বল তোমার স্ত্রী ? ওই শব্দটাকে নিজের ফুয়ে ফুলিয়ে তুলে দিনরাত্রি সামলে বেড়াচ্ছ—জান, বাইরে থেকে একটা পিন ফুটলেই এক মুহূর্তে হাওয়া বেরিয়ে গিয়ে সমস্তটা চুপসে যাবে।