পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য OL6 তারে যেন একটা সংগীত বাজাইয়া তোলে। ইহা মুন্দর ভাষাতেই সুন্দর ছন্দেই স্বন্দর করিয়া সাজাইয়া স্থায়ী করিয়া রাখিৰার বিষয় । ছোটো ভাই বড়ো ভাইয়ের সেবা করিলে সমাজের হিত হয় বলিয়া যে এ-কথা বলিতেছি, তাহা নহে, ইহা সুন্দর বলিয়াই। কেন মুন্দর ? কারণ, মঙ্গলমাত্রেরই সমস্ত জগতের সঙ্গে একটা গভীরতম সামঞ্জস্ত আছে, সকল মানুষের মনের সঙ্গে তাহার নিগৃঢ় মিল আছে। সত্যের সঙ্গে মঙ্গলের সেই পূর্ণ সামঞ্জস্ত দেখিতে পাইলেই তাহার সৌন্দর্য আর আমাদের অগোচর থাকে না। করুণা স্বন্দর, ক্ষমা স্বন্দর, প্রেম স্বন্দর –শতদলপদ্মের সঙ্গে, পূর্ণিমার চাদের সঙ্গে তাহার তুলনা হয় ; শতদলপদ্মের মতো, পূর্ণিমার চাদের মতো নিজের মধ্যে এবং চারিদিকের জগতের মধ্যে তাহার একটি বিরোধহীন সুষমা আছে ;–সে নিখিলের অমুকুল এবং নিখিল তাহার অমুকুল । আমাদের পুরাণে লক্ষ্মী কেবল সৌন্দর্ধ এবং ঐশ্বর্ষের দেবী নহেন, তিনি মঙ্গলের দেবী । সৌন্দর্যমূর্তিই মঙ্গলের পূর্ণমূর্তি এবং মঙ্গলমূর্তিই সৌন্দর্যের পূর্ণস্বরূপ । সৌন্দর্বে ও মঙ্গলে ষে-জায়গায় মিল আছে, সে-জায়গাট। বিচার করিয়া দেখা যাক । আমরা প্রথমে দেখাইয়াছি, সৌন্দর্য প্রয়োজনের বাড়া । এইজন্ত তাহাকে আমরা ঐশ্বর্য বলিয়া মানি । এইজন্ত তাহা আমাদিগকে নিছক স্বার্থসাধনের দারিদ্র্য হইতে প্রেমের মধ্যে মুক্তি দেয়। মঙ্গলের মধ্যে আমরা সেই ঐশ্বর্য দেখি। যখন দেখি, কোনো বীরপুরুষ ধর্মের জন্ত স্বার্থ ছাড়িয়াছেন, প্রাণ দিয়াছেন, তখন এমন একটা আশ্চর্ষ পদার্থ আমাদের চোখে পড়ে, যাহা আমাদের স্থখছুঃখের চেয়ে বেশি, আমাদের স্বার্থের চেয়ে বড়ো, আমাদের প্রাণের চেয়ে মহৎ । মঙ্গল নিজের এই ঐশ্বর্ষের জোরে ক্ষতি ও ক্লেশকে ক্ষতি ও ক্লেশ বলিয়া গণ্যই করে না । স্বার্থের ক্ষতিতে তাহার ক্ষতি হইবার জো নাই । এইজন্ত সৌন্দর্য যেমন আমাদিগকে স্বেচ্ছাকৃত ত্যাগে প্রবৃত্ত করে, মঙ্গলও সেইরূপ করে। সৌন্দর্ধও জগদব্যাপারের মধ্যে ঈশ্বরের ঐশ্বর্ধকে প্রকাশ করে, মঙ্গলও মানুষের জীবনের মধ্যে তাহাই করিয়া থাকে ; মঙ্গল, সৌন্দর্যকে শুধু চোখের দেখা নয়, শুধু বুদ্ধির বোঝা নয়, তাহাকে আরও ব্যাপক আরও গভীর করিয়া মানুষের কাছে আনিয়া দিয়াছে ; তাহা ঈশ্বরের সামগ্রীকে অত্যন্তই মানুষের সামগ্ৰী করিয়া তুলিয়াছে। বস্তুত মঙ্গল মাছুষের নিকটবর্তী অন্তরতম সৌন্দর্য ; এইজগুই তাহাকে আমরা অনেকসময় সহজে মুন্দর বলিয়া বুঝিতে পারি ন!—কিন্তু যখন বুঝি, তখন আমাদের প্রাণ বর্ষার নদীর মতো ভরিয়া উঠে। তখন আমরা তাহার চেয়ে রমণীয় আর কিছুই দেখি না।