পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Głół R রবীন্দ্র-রচনাবলী মরে । তার যা অন্নজল তা বাইরের জীবন রক্ষার জন্য একান্ত আবশ্যক নয়, কিন্তু তবু মানুষ এই খাদ্য সংগ্ৰহ করতে আপনার বাইরের জীবনকে বিসর্জন করেছে । এই ভিতরকার জীবনটিকে মানুষ অনাদর করে নি— এমন-কি, তাকেই বেশি আদর করেছে এবং তাই যারা করেছে তারাই সভ্যতার উচ্চশিখরে অধিরোহণ করেছে। মানুষ বাইরের জীবনটাকেই যখন একান্ত বড়ো করে তোলে তখন সব দিক থেকেই তার সুর নেবে যেতে থাকে । দুৰ্গমের দিকে, গোপনের দিকে, গভীরতার দিকে, মানুষের চেষ্টাকে যখন টানে তখনই মানুষ বড়ো হয়ে ওঠে, ভুমার দিকে অগ্রসর হয়— তখনই মানুষের চিত্ত সর্বতোভাবে জাগ্রত হতে থাকে। যা সুগম, যা প্রত্যক্ষ, তাতে মানুষের সমস্ত চেতনাকে উদ্যম দিতে পারে না, এইজন্য কেবলমাত্র সেই দিকে আমাদের মনুষ্যত্ব সম্পূর্ণতা লাভ করে না। তা হলে দেখতে পাচ্ছি, মানুষের মধ্যেও একটি সত্তা আছে যেটি গুহাহিত ; সেই গভীর সত্তাটিই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের যিনি গুহাহিত র্তার সঙ্গেই কারবার করে- সেই তার আকাশ, তার বাতাস, তার আলোক ; সেইখানেই তার স্থিতি, তার গতি, সেই গুহালোকই তার লোক । এইখান থেকে সে যা-কিছু পায় তাকে বৈষয়িক পাওয়ার সঙ্গে তুলনা করাই যায় না- তাকে মাপ করে ও জন করে দেখবার কোনো উপায়ই নেই— তাকে যদি কোনো স্থূলদৃষ্টি ব্যক্তি অস্বীকার করে বসে, যদি ব'ল, কী তুমি পেলে একবার দেখি”— তা হলে বিষম সংকটে পড়তে হয়। এমন-কি, যা বৈজ্ঞানিক সত্য, প্রত্যক্ষ সত্যের ভিত্তিতেই যার প্রতিষ্ঠা তার সম্বন্ধেও প্রত্যক্ষতার স্থূল আবদার চলে না। আমরা দেখাতে প“াির, ভারী জিনিস হাত থেকে পড়ে যায় কিন্তু মহাকর্ষণকে দেখাতে পারি। নে ! অত্যন্ত মূঢ়ও যদি বলে, ‘আমি সমুদ্র দেখব, আমি হিমালয় পর্বত দেখব, তবে তাকে এ কথা বলতে হয় না যে, “আগে তোমার চোখদুটােকে মস্ত-বড়ো করে তোলো। তবে তোমাকে পর্বত সমুদ্র দেখিয়ে দিতে পারব”- কিন্তু সেই মূঢ়ই যখন ভূবিদ্যার কথা জিজ্ঞাসা করে তখন তাকে বলতেই হয়, “একটু রোসো ; গোড়া থেকে শুরু করতে হবে ; আগে তোমার মনকে সংস্কারের আবরণ থেকে মুক্ত করে তবে এর মধ্যে তোমার অধিকার হবে { অর্থাৎ চােখ মেললেই চলবে না, কান খুললেই হবে না, তোমাকে গুহার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে।” মূঢ় যদি বলে, “না, আমি সাধনা করতে রাজি নই, আমাকে তুমি এসমস্তই চোখে-দেখা কানে-শোনার মতো সহজ করে দাও), তবে তাকে হয় মিথ্যা দিয়ে ভোলাতে হয়, নয়। তার অনুরোধে কৰ্ণপাত করাও সময়ের বৃথা অপব্যয় বলে গণ্য করতে হয় । তাই যদি হয় তবে উপনিষৎ র্যাকে গুহাহিত্যং গহবরেষ্টং বলেছেন, যিনি গভীরতম, তাকে দেখাশোনার সামগ্ৰী করে বাইরে এনে ফেলবার অদ্ভুত আবদার আমাদের খাটতেই পারে না । এই আবদার মিটিয়ে দিতে পারেন এমন গুরুকে আমরা অনেকসময় খুঁজে থাকি, কিন্তু যদি কোনো গুরু বলেন, “আচ্ছা বেশ, তাকে খুব সহজে করে দিচ্ছি"- বলে সেই যিনি নিহিতং গুহায়াং তঁকে আমাদের চোখের সম্মুখে। যেমন-খুশি একরকম করে দাড় করিয়ে দেন, তা হলে বলতেই হবে, তিনি অসত্যের দ্বারা গোপনকে আরো গোপন করে দিলেন ; এরকম স্থলে শিষ্যকে এই কথাটাই বলবার কথা যে, মানুষ যখন সেই গুহাহিতকে, সেই গভীরকে চায়, তখন তিনি গভীর বলেই তাকে চায়— সেই গভীর আনন্দ আর-কিছুতে মেটাতে পারে না বলেই তাকে চায়চোখে-দেখা কানে-শোনার সামগ্ৰী জগতে যথেষ্ট আছে, তার জনো আমাদের বাইরের মানুষটা তো দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু আমাদের অন্তরতর গুহাহিত তপস্বী সে-সমস্ত কিছু চায় না বলেই একাগ্রমনে তার দিকে চলেছে । তুমি যদি তাকে চাও তবে গুহার মধ্যে প্রবেশ করেই তার সাধনা করে- এবং যখন তাকে পাবে, তোমার ‘গুহাশয়’ রূপেই তাকে পাবে ; অন্য রূপে যে তাকে চায় সে তাকেই চায় না ; সে কেবল বিষয়কেই অন্য একটা নাম দিয়ে চাচ্ছে । মানুষ সকল পাওয়ার চেয়ে র্যাকে চাচ্ছে, তিনি সহজ বলেই তাকে চাচ্ছে না— তিনি ভূমা বলেই তঁকে চাচ্ছে। যিনি ভুমা, সর্বত্রই তিনি গুহাহিতং, কি সাহিত্যে কি ইতিহাসে, কি শিল্পে, কি ধর্মে কি কর্মে । এই যিনি সকলের চেয়ে বড়ো, সকলের চেয়ে গভীর, কেবলমাত্র তাকে চাওয়ার মধ্যেই একটা সার্থকতা আছে । সেই ভূমাকে আকাঙক্ষা করাই আত্মার মাহাত্ম্য- ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি, এই কথাটি যে মানুষ বলতে পেরেছে, এতেই তার মনুষ্যত্ব । ছোটােতে তার সুখ নেই, সহজে তার সুখ নেই, এইজন্যেই সে