পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VV রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ՏԳ উদবোধন আজ আমাদের আশ্রমের এই বিশেষ দিনে আমাদের চিত্ত জাগ্ৰত হােক । সংসারের মধ্যে আমাদের যে উৎসবের দিন আসে সে দিন অন্য দিন থেকে স্বতন্ত্র, প্রতিদিনের সঙ্গে তার সুর মেলে না । কিন্তু, আমাদের এই উৎসবের দিনের সঙ্গে প্রতিদিনের যোগ আছে, এ যেন মেতির হারের মাঝখানে হীরার দোলক । যোগ আছে, আবার বিশেষত্বও আছে। কেননা, ঐ বিশেষত্বের জন্যে মানুষের একটু আকাঙক্ষা আছে। মানুষ এক-একদিন প্রতিদিনের জীবন থেকে একটু সরে এসে তার আনন্দের আস্বাদ পেতে চায় । যেজন্যে আমরা ঘরের অন্নকে একটু দূরে নিয়ে খাবার জন্যে বনভোজনে যাই। প্রত্যহের সামগ্ৰীকেই তার অভ্যাস থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু নুতন করে পেতে চাই। তাই আজ আমরা আমাদের আশ্রমের অন্নকে একটু সরে এসে একটু বিশেষ করে ভোগ করবার জন্যে আয়োজন করেছি। কিন্তু, বনভোজনের আয়োজনে যখন খাদ্যসামগ্ৰী দূরে এবং একটু বড়ো করে বয়ে নিয়ে যেতে হয় তখন আমাদের ভাড়ারের হিসাবটা মুহুর্তের মধ্যে চোখে পড়ে যায়। যদি প্রতিদিন অপব্যয় হয়ে থাকে তা হলে সেদিন দেখব টানাটানি পড়ে গেছে। আজ আমাদের অমৃত-অন্নের বনভোজনের আয়োজনে হয়তো অভাব দেখতে পাব ; যদি পাই, তবে সেই অন্তরের অভাবকে বাইরের কী দিয়েই বা ঢাকা দেব । যারা শহরে থাকে তাদের সাজসরঞ্জামের অভাব নেই, তাই দিয়েই তারা তাদের উৎসবের মােনরক্ষা করতে পারে। আমাদের এখানে সে-সমস্ত উদযোগের পথ বন্ধ । কিন্তু, ভয় নেই। প্ৰতিদিনই আমাদের আশ্রমের উৎসবের বায়না দেওয়া গেছে। এখানকার শালবনে পাখির বাসায়, এখানকার প্রান্তরের আকাশে বাতাসের খেলার প্রাঙ্গণে, প্রতিদিনই আমাদের উৎসবের সুর কিছু-না-কিছু জিমেছে। কিন্তু প্রতিদিনের অন্যমনস্কতায় সেই রোশন'চৌকি ভালো করে। প্ৰাণে পৌঁছয় নি। আজ আমাদের অভ্যাসের জড়তাকে ঠেলে দিয়ে একবার মন দিতে পারলেই হয়, আর-কিছু বাইরে থেকে সংগ্ৰহ করতে হবে না। চিত্তকে শান্ত করে বসি, অঞ্জলি করে হাত পাতি, তা হলে মধুবনের মধুফল আপনিই হাতে এসে পড়বে। যে আয়োজন চারিদিকে আপনিই হয়ে আছে তাকেই ভোগ করাই যে আমাদের উৎসব । প্রতিদিন ডাকি নি বলেই র্যাকে দেখি নি, আজ মনের সঙ্গে ডাক দিলেই যে তাকে দেখতে পাব । বাইরের উত্তেজনায় ধাক্কা দিয়ে মনকে চেতিয়ে তোলা, তাতে আমাদের দরকার নেই। কেননা, তাতে লাভ নেই, বরঞ্চ শক্তির ক্ষয় হয় । গাছের ভিতরের রসে যখন বসন্তের নাড়া পায় তখনই ফুল ফোটে ; সেই ফুলই সত্য। বাইরের উত্তেজনায় যে ক্ষণিক মোহ আনে সে কেবল মরীচিকা ; তাতে যেন না ভুলি। আমাদের ভিতরকার শক্তিকে উদবোধিত করি। ক্ষণকালের জন্যেও যদি তার সাড়া পাই তখন তার সার্থকতা চিরদিনের। যদি মুহুর্তের জন্যও আমরা সত্য হতে পারি। তবে সে সত্য কোনোদিন মরবে না ; সেই অমৃতবীজ চিরকালের মতো আমাদের চিরজীবনের ক্ষেত্রে বোনা হয়ে যাবে। যে পুণ্য হােমাগ্নি বিশ্বের যজ্ঞশালায় চিরদিন জ্বলছে তাতে যদি ঠিকমত করে একবার আমাদের চিত্তপ্রদীপের মুখটুকু ঠেকিয়ে দিতে পারি, তা হলে সেই মুহুর্তেই আমাদের শিখাটুকু ধরে উঠতে পারে । , সত্যের মধ্যে আজ আমাদের জাগরণ সম্পূর্ণ হােক, এই প্ৰভাতের আলোক আজ আমাদের আবরণ না হােক, আজ চিরাজ্যোতি প্ৰকাশিত হােন, ধরণীর শ্যামল যবনিকা আজ যেন কিছু গোপন না করে- আজি চিরসুন্দর দেখা দিন। শিশু যেমন মাকে সম্পূর্ণরূপে আলিঙ্গন করে তেমনি করেই আজ সেই পরম চৈতন্যের সঙ্গে আমাদের চৈতন্যের মিলন হােক। যেমন কবির কাব্য পাঠ করবার সময় তার ছন্দ ও ভাষার ভিতর দিয়ে কবির আনন্দের মধ্যে গিয়ে আমাদের চিত্ত উপনীত হয়, তেমনি করে আজ এই শিশিরক্সানে স্নিগ্ধ নির্মল বিশ্বশোভার অন্তরে সেই বিশ্বের আনন্দকে যেন সমস্ত হৃদয় মন দিয়ে প্রত্যক্ষ অনুভব করি । ৭ পৌষ SV)AO TS SVSo