পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७8२ রবীন্দ্র-রচনাবলী অতিশয় ব্যাকুলত প্রকাশ করিয়াছিলেন—কেননা "সিংহ মায়ের বাহন” । শক্তিকে সিংহরূপে কল্পনা করিতে দোষ নাই—কিন্তু সিংহকেই শক্তিরূপে যদি দেখি তবে কল্পনার মহত্ত্বই চলিয়া যায়। কারণ, ষে কল্পনা সিংহকে শক্তির প্রতিরূপ করিয়া দেখায় সেই কল্পনা সিংহে আসিয়া শেষ হয় না বলিয়াই আমরা তাহার রূপ-উদ্ভাবনকে সত্য বলিয়া গ্রহণ করি—যদি তাহ কোনো এক জায়গায় আসিয়া বন্ধ হয় তবে তাহু মিথ্যা, তবে তাহ মানুষের শক্র । যাহা স্বভাবতই প্রবহমান তাহাকে কোনো একটা জায়গায় রুদ্ধ করিবণমাত্র তাহা যে মিথ্যা হইয়া উঠিতে থাকে সমাজে তাহার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। আচার জিনিসটা অনেক স্থলেই সেই বন্ধন-আকার ধারণ করে। তাহার সময় উত্তীর্ণ হইলেও অভ্যাসের আসক্তিবশত আমরা তাহাকে ছাড়িয়া দিতে চাই না। যাহার মুখ্য উদ্বেগু চলা এবং চালানো, এক সময়ে তাহাকেই আমরা খোটার মতে ব্যবহার করি, অথচ মনে করি যেন তাহার উদ্দেশু সিদ্ধি হইতেছে। একটা উদাহরণ দিই। জগতে বৈষম্য আছে। বস্তুত বৈষম্য স্বাক্টর মূলতত্ত্ব। কিন্তু সেই বৈষম্য ধ্রুব নহে। পৃথিবীতে ধনমান বিদ্যাক্ষমতা একজায়গায় স্থির নাই, তাহা আবর্তিত হইতেছে । আজ যে ছোটো কাল সে বড়ো, আজ যে ধনী কাল সে দরিদ্র । বৈষম্যের এই চলাচল আছে বলিয়াই মানবসমাজে স্বাস্থ্য আছে । কেননা বৈষম্য না থাকিলে গতিই থাকে না—উচু-নিচু না থাকিলে নদী চলে না, বাতাসে তাপের পার্থক্য না থাকিলে বাতাস বহে না । যাহা চলে না এবং যাহা সচল পদার্থের সঙ্গে যোগ রাখে না তাহ দূষিত হইতে থাকে। অতএব, মানবসমাজে উচ্চ নীচ আছেই, থাকিবেই এবং থাকিলেই ভালো, একথা মানিতে হুইবে । কিন্তু এই বৈষম্যের চলাচলকে যদি বাধ দিয়া বাধিয়া ফেলি, যদি একশ্রেণীর লোককে পুরুষানুক্রমে মাথায় করিয়া রাখিব এবং আর এক শ্রেণীকে পায়ের তলায় ফেলিব এই বাধা নিয়ম একেবারে পাকা করিয়া দিই তবে বৈষম্যের প্রকৃতিগত উদ্বেগুই একেবারে মাটি করিয়া ফেলি। যে বৈষম্য চাকার মতো আবর্তিত হয় না, সে বৈষম্য নিদারুণ ভারে মানুষকে চাপিয়া রাখে, তাহ মানুষকে অগ্রসর করে না। জগতে বৈষম্য ততক্ষণ সত্য যতক্ষণ তাহ চলে, যতক্ষণ তাহা মুক্ত—জগতে লক্ষ্মী যতক্ষণ চঞ্চল ততক্ষণ তিনি কল্যাণদায়িনী। লক্ষ্মীকে এক জায়গায় চিরকাল বাধিতে গেলেই তিনি অলক্ষ্মী হইয়া উঠেন। কারণ, চঞ্চলতার দ্বারাই লক্ষ্মী বৈষম্যের মধ্যে সাম্যকে আনেন। দুঃখী চিরদিন দুঃখী নয়, সুখী চিরদিন মুবী নয়—এইখানেই মুখীতে দুঃখীতে সাম্য আছে । মুখ দুঃখের এই চলাচল আছে বলিয়াই মুখ দুঃখের স্বন্ধে মানুষের মঙ্গল ঘটে।