পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী و C ) যাহারা বস্তুর কারবার করিয়া থাকে তাহারা যেটাকে অবস্তু ও শূন্ত বলিয়া মনে করে সেটা কম জিনিস নয়। লোকালয়ের হাটে ভূমি বিক্রি হয়, আকাশ বিক্রি হয় না। কিন্তু পৃথিবীর বস্তু-পিণ্ডকে ঘেরিয়া যে বায়ুমণ্ডল আছে, জ্যোতিলোক হইতে আলোকের দূত সেই পথ দিয়াই আনাগোনা করে। পৃথিবীর সমস্ত লাবণ্য ওই বায়ুমণ্ডলে । ওইখানেই তাহার জীবন। ভূমি ধ্রুব, তাহা ভারি, তাহার একটা হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে ষে কত পাগলামি তাহা বিজ্ঞ লোকের অগোচর নাই। তাহার মেজাজ কে বোঝে ? পৃথিবীর সমস্ত প্রয়োজন ধূলির উপরে, কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত সংগীত ওই শূন্তে,—যেখানে তাহার অপরিচ্ছিন্ন অবকাশ । মানুষের চিত্তের চারিদিকেও একটি বিশাল আকাশের বায়ুমণ্ডল আছে। সেইখানেই তাহার নানারঙের খেয়াল ভাসিতেছে ; সেইখানেই অনন্ত তাহার হাতে আলোকের রাখি বাধিতে আসে ; সেইখানেই ঝড়বৃষ্টি, সেইখানেই উনপঞ্চাশ বায়ুর উন্মত্তত, সেখানকার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। মানুষের ষে অতিচৈতন্যলোকে অভাবনায়ের লীলা চলিতেছে সেখানে যে সব অকেজো লোক আনাগোনা রাখিতে চায় - তাহারা মাটিকে মান্ত করে বটে কিন্তু বিপুল অবকাশের মধ্যেই তাহাদের বিহার । সেখানকার ভাষাই সংখীত। এই সংগীতে বাস্তবলোকে বিশেষ কী কাজ হয় জানি না – কিন্তু ইহারই কম্পমান পক্ষের আঘাত-বেগে অতিচৈতন্যলোকের সিংহদ্বার খুলিয়। যায় । o মামুষের ভাষার দিকে একবার তাকাও । ওই ভাষাতে মানুষের প্রকাশ ; সেই জন্তে উহার মধ্যে এত রহস্ত। শব্দের বস্তটা হইতেছে তাহার অর্থ। মানুষ যদি কেবলমাত্র হইত বাস্তব, তবে তাহার ভাষার শব্দে নিছক অর্থ ছাড়া আর কিছুই থাকিত না। তবে তাহার শব্দ কেবলমাত্র খবর দিত,—সুর দিত না । কিন্তু বিস্তর শব্দ আছে যাহার অর্থপিণ্ডের চারিদিকে আকাশের অবকাশ আছে, একটা বায়ুমণ্ডল আছে । তাহারা যেটুকু জানায় তাহারা তাহার চেয়ে অনেক বেশি—তাহাদের ইশারা তাহাদের বাণীর চেয়ে বড়ে । ইহাদের পরিচয় তদ্ধিত প্রত্যয়ে নহে, চিত্তপ্রত্যয়ে । এই সমস্ত অবকাশওয়ালা কথা লইয়া অবকাশ-বিহারী কবিদের কারবার। এই অবকাশের বায়ুমণ্ডলেই নানা রঙিন আলোর রং ফলাইবার সুযোগ—এই ফাকটাতেই ছন্দগুলি নানা ভঙ্গিতে হিল্লোলিত হয়। এই সমস্ত অবকাশবহুল রঙিন শব্দ যদি না থাকিত তবে বুদ্ধির কোনো ক্ষতি হইত না কিন্তু হৃদয় যে বিনা প্রকাশে বুক ফ্লাটিয়া মরিত। অনির্বচনীয়কে লইয়া তাহার প্রধান কারবার ; এই জন্য অর্থে তাহার অতি সামান্ত প্রয়োজন। বুদ্ধির দরকার