পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

orge V8 বাল্যকাল হইতেই আমার অগ্নিপরীক্ষার আরম্ভ হয় । চোদ্দ বৎসর পার না হইতেই আমি একটি মৃতশিশু জন্ম দিলাম ; নিজেও মরিবার কাছাকাছি গিয়াছিলাম। কিন্তু যাহাকে দুঃখভোগ করিতে হইবে সে মরিলে চলিবে কেন । যে দীপ জ্বলিবার জন্য হইয়াছে তাহার তেল অল্প হয় না ; রাত্রিভোর জ্বলিয়া তবে তাহার নির্বাণ । বঁচিলাম বটে কিন্তু শরীরের দুর্বলতায়, মনের খেদো, অথবা যে কারণেই হউক, আমার চোখের ओएफ्ला इश्वन । আমার স্বামী তখন ডাক্তারি পড়তেছিলেন । নূতন বিদ্যাশিক্ষার উৎসাহবশত চিকিৎসা করিবার সুযোগ পাইলে তিনি খুশি হইয়া উঠিতেন । তিনি নিজেই আমার চিকিৎসা আরম্ভ করিলেন । দাদা সে বছর বি. এল. দিবেন বলিয়া কলেজে পড়িতেছিলেন । তিনি একদিন আসিয়া আমার স্বামীকে কহিলেন, “করিতেছ। কী । কুমুর চোখ দুটাে যে নষ্ট করিতে বসিয়াছ। একজন ভালো ডাক্তার দেখাও ।” আমার স্বামী কহিলেন, “ভালো ডাক্তার আসিয়া আর নূতন চিকিৎসা কী করিবে । ওষুধপত্র তো সব জানাই আছে ।” দাদা কিছু রাগিয়া কহিলেন, “তবে তো তোমার সঙ্গে তোমাদের কলেজের বড়োসাহেবের কোনো 26ख्म नाछ ।" স্বামী বলিলেন, “আইন পড়িতেছ, ডাক্তারির তুমি কী বোঝা । তুমি যখন বিবাহ করিবে তখন তোমার স্ত্রীর সম্পত্তি লইয়া যদি কখনো মকদ্দমা বাধে তুমি কি আমার পরামর্শমত চলিবে ।” আমি মনে মনে ভাবিতেছিলাম, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হইলে উলুখড়েরই বিপদ সবচেয়ে বেশি। স্বামীর সঙ্গে বিবাদ বাধিল দাদার, কিন্তু দুইপক্ষ হইতে বাজিতেছে আমাকেই । আবার ভাবিলাম, দাদারা যখন আমাকে দানই করিয়াছেন তখন আমার সম্বন্ধে কর্তব্য লইয়া। এ-সমস্ত ভাগাভাগি কেন । আমার সুখদুঃখ, আমার রোগ ও আরোগ্য, সে তো সমস্তই আমার স্বামীর । সেদিন আমার এই এক সামান্য চোখের চিকিৎসা লইয়া দাদার সঙ্গে আমার স্বামীর যেন একটু মনান্তর হইয়া গেল । সহজেই আমার চোখ দিয়া জল পড়িতেছিল, আমার জলের ধারা আরো বাড়িয়া উঠিল ; তাহার প্রকৃত কারণ আমার স্বামী কিংবা দাদা কেহই তখন বুঝিলেন না । আমার স্বামী কলেজে গেলে বিকালবেলায় হঠাৎ দাদা এক ডাক্তার লইয়া আসিয়া উপস্থিত । ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া কহিল, সাবধানে না থাকিলে পীড়া শুরুতর হইবার সম্ভাবনা আছে। এই বলিয়া কী-সমস্ত ওষুধ লিখিয়া দিল, দাদা তখনই তাহা আনাইতে পাঠাইলেন । ডাক্তার চলিয়া গেলে আমি দাদাকে বলিলাম, “দাদা, আপনার পায়ে পড়ি, আমার যে চিকিৎসা চলিতেছে তাহাতে কোনোরূপ ব্যাঘাত ঘটাইবেন না ।” আমি শিশুকাল হইতে দাদাকে খুব ভয় করিতাম ; তোহাকে যে মুখ ফুটিয়া এমন করিয়া কিছু বলিতে পারিব, ইহা আমার পক্ষে এক আশ্চর্য ঘটনা। কিন্তু, আমি বেশ বুঝিয়াছিলাম, আমার স্বামীকে লুকাইয়া দাদা আমার যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতেছেন তাহাতে আমার অশুভ বৈ শুভ নাই। দাদাও আমার প্রগলভ্যতায় বোধ করি কিছু আশ্চর্য হইলেন । কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিয়া অবশেষে বলিলেন, “আচ্ছা, আমি আর ডাক্তার আনিব না, কিন্তু যে ওষুধটা আসিবে তাহা বিধিমতে সেবন করিয়া দেখিস ।” ওষুধ আসিলে পর আমাকে তাহা ব্যবহারের নিয়ম বুঝাইয়া দিয়া চলিয়া গেলেন । স্বামী কালেজ হইতে আসিবার পূর্বেই আমি সে কোটা এবং শিশি এবং তুলি এবং বিধিবিধান সমস্তই সযত্নে আমাদের প্রাঙ্গণের পাতকুয়ার মধ্যে ফেলিয়া দিলাম । দাদার সঙ্গে কিছু আড়ি করিয়াই আমার স্বামী যেন আরো দ্বিগুণ চেষ্টায় আমার চোখের চিকিৎসায় প্ৰবৃত্ত হইলেন । এবেলা ওবেলা ওষুধ বদল হইতে লাগিল । চোখে ঠেলি পরিলাম, চশমা পরিলাম, চোখে ফোটা ফোটা করিয়া ওষুধ ঢালিলাম, গুড়া লাগাইলাম, দুৰ্গন্ধ মাছের তেল খাইয়া ভিতরকার পাকযন্ত্রসূদ্ধ যখন বাহির হইবার উদ্যম কিরিত তাহাও দমন করিয়া রহিলাম ।