পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5R 55落 8S আমার পিতার মতামত অনেকরকম ছিল ; কিন্তু বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কোনো মত তিনি কেতাব বা স্বাধীনবৃদ্ধি হইতে গডিয়া তোলেন নাই । আমার বিবাহ যখন হয় তখন সতেরো উত্তীর্ণ হইয়া আঠারোয় পা দিয়াছি ; তখন আমি কলেজে থার্ডইয়ারে পন্ডি- এবং তখন আমার চিত্তক্ষেত্রে যৌবনের প্রথম দক্ষিণবাতাস বহিতে আরম্ভ করিয়া কত অলক্ষ্য দিক হইতে কত অনির্বচনীয় গীতে এবং গন্ধে, কম্পনে এবং মর্মরে আমার তরুণ জীবনকে উৎসুক করিয়া তুলিতেছিল, তাহা এখনো মনে হইলে বুকের ভিতরে দীর্ঘনিশ্বাস ভরিয়া উঠে । তখন আমার মা ছিলেন না— আমাদের শূন্যসংসারের মধ্যে লক্ষ্মীস্থাপন করিবার জন্য আমার পড়াশুনা শেষ হইবার অপেক্ষা না কবিয়াই, বাবা বারো বৎসরের বালিকা নিঝরিণীকে আমাদের ঘরে আনিলেন । নিকারিণী নামটি হঠাৎ পাঠকদের কাছে প্রচার করিতে সংকোচবোধ করিতেছি । কারণ, তাহাদের অনেকেবই বয়স হইয়াছে- অনেকে ইস্কুল-মাস্টারি মুনসেফি এবং কেহ কেহ বা সম্পাদকিও করেন, তাহারা আমার শ্বশুর মহাশয়ের নামনির্বাচনকচির অতিমাত্র লালিত্য এবং নূতনত্বে হাসিবেন এমন আশঙ্কা আছে ; কিন্তু আমি তখন অর্বাচীন ছিলাম, বিচার শক্তির কোনো উপদ্রব্য ছিল না, তাই নামটি বিবাহের সম্বন্ধ হইবার সময়েই যেমনি শুনিলাম আমনি কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্রাণ - এখন বয়স হইয়াছে এবং ওকালতি ছাডিয়া মুনসেফি-লাভের জন্য বাগ্র হইয়া উঠিয়াছি, তবু হৃদয়ের মধ্যে ঐ নামটি পূর্বাতন বেহালার আওয়াজের মতো আরো বেশি মোলযেম হইয়া বাজিতেছে প্ৰথম বয়সের প্রথম প্রেম অনেকগুলি ছোটােখাটাে বাধার দ্বারা মধুর। লজ্জার বাধা, ঘরের লোকের বাধা, অনভিজ্ঞতার বাধা- এইগুলির অন্তরাল হইতে প্ৰথম পরিচয়ের যে আভাস দিতে থাকে তাহা ভোবের আলোর মতো রঙিন— তাহা মধ্যাহ্নের মতো সুস্পষ্ট, অনাবৃত এবং বর্ণচ্ছটাবিহীন | আমাদের সেই নবীন পরিচয়ের মাঝখানে বাবা বিন্ধীগিরির মতো দাড়াইলেন । তিনি আমাকে হস্টেলে নির্বাসিত কবিয়া দিয়া তাহার বউমাকে বাংলা লেখাপড়া শিখাইতে প্ৰবৃত্ত হইলেন । আমার এই গল্পের শুরু হইল সেইখানে । শ্বশুরমশায় কেবল তাহার কন্যার নামকরণ করিয়াই নিশ্চেষ্ট ছিলেন না, তিনি তাহাকে শিক্ষাদানেরও প্রভূত আয়োজন কবিয়াছিলেন । এমন-কি, উপক্ৰমণিকা তাহার মুখস্থ শেষ হইয়াছিল । মেঘনাদবধ কাব্য পডিতে হেমবাবুর টীকা তাহার প্রয়োজন হইত না । হস্টেলে গিয়া তাহার পরিচয় পাইয়াছিলাম। আমি সেখানে থাকিতে নানা উপায়ে বাবাকে লুকাইয়া নববিরহীতাপে অতান্ত উত্তপ্ত দুই-একখানা চিঠি তাহাকে পাঠাইতে আরম্ভ করিয়াছিলাম । তাহাতে কোটেশন-মার্কা না দিয়া আমাদের নবা কবিদের কাব্য ছাকিয়া অনেক কবিতা ঢালিয়াছিলাম ; ভাবিয়ছিলাম- প্ৰণয়িনীর কেবল প্ৰেম আকর্ষণ করাই যথেষ্ট নহে, শ্রদ্ধাও চাই । শ্রদ্ধা পাইতে হইলে বাংলা ভাষায় যেরূপ রচনাপ্ৰণালীর আশ্রয় লওয়া উচিত সেটা আমার স্বভাবত আসিত না, সেইজন্য, মণীে বীজসমূৎকীৰ্ণে সূত্রসোবান্তি মে গতিঃ । অর্থাৎ অনা জহরিরা যে-সকল মণি ছিদ্র করিয়া রাখিয়াছিলেন, আমার চিঠি তাহা সূত্রের মতো গাথিয়া পাঠাইত । কিন্তু, ইহার মধ্যে মণিগুলি অন্যের, কেবলমাত্র সূত্রটুকুই আমার, এ বিনয়টুকু স্পষ্ট করিয়া প্রচার করা আমি ঠিক সংগত মনে করি নাইকালিদাসও করিতেন না, যদি সত্যই তাহার মণিগুলি চোরাই মাল হইত । চিঠির উত্তর যখন পাইলাম তাহার পর হইতে যথাস্থানে কোটেশন-মার্কা দিতে আর কাপণ্য করি নাই । এটুকু বেশ বোঝা গেল, নববধূ বাংলাভাষাটি বেশ জানেন । তাহার চিঠিতে বানান-ভুল ছিল কি না তাহার উপযুক্ত বিচারক আমি নই।-- কিন্তু সাহিত্যবোধ ও ভাষাবোধ না থাকিলে এমন চিঠি লেখা যায় না, সেটুকু আন্দাজে বুঝিতে পারি।