পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী めの শচীশের ডায়ারিতে লেখা আছে : গুহার মধ্যে অনেকগুলি কামরা । আমি তার মধ্যে একটাতে কম্বল পাতিয়া শুইলাম । সেই গুহার অন্ধকারটা যেন একটা কালো জন্তুর মতো- তার ভিজা নিশ্বাস যেন আমার গায়ে লাগিতেছে। আমার মনে হইল সে যেন আদিম কালের প্রথম সৃষ্টির প্রথম জন্তু ; তার চােখ নাই, কান নাই, কেবল তার মস্ত একটা ক্ষুধা আছে ; সে অনন্ত কাল এই গুহার মধ্যে বন্দী ; তার মন নাই— সে কিছুই জানে না, কেবল তার ব্যথা আছে- সে নিঃশব্দে কঁদে । ক্লান্তি একটা ভারের মতো আমার সমস্ত শরীরকে চাপিয়া ধরিল, কিন্তু কোনোমতেই ঘুম আসিল না। একটা কী পাখি, হয়তো বাদুড় হইবে, ভিতর হইতে বাহিরে কিংবা বাহির হইতে ভিতরে ঝাপঝাপ ডানার শব্দ করিতে করিতে অন্ধকার হইতে অন্ধকারে চলিয়া গেল। আমার গায়ে তার হাওয়া দিতে সমস্ত গায়ে কাটা দিয়া উঠিল । 擎 মনে করিলাম, বাহিরে গিয়া শুইব । কোন দিকে যে গুহার দ্বার তা ভুলিয়া গেছি। গুড়ি মারিয়া এক দিকে চলিতে চেষ্টা করিয়া মাথা ঠেকিয়া গেল, আর-এক দিকে মাথা ঠুকিলাম, আর-এক দিকে একটা ছোটাে গর্তের মধ্যে পড়িলাম- সেখানে গুহার ফাটল-চোয়ানো জল জমিয়া আছে। শেষে ফিরিয়া আসিয়া কম্বলটার উপর শুইলাম । মনে হইল সেই আদিম জন্তুটা আমাকে তার লালাসিক্ত কবলের মধ্যে পুরিয়াছে, আমার কোনো দিকে আর বাহির হইবার পথ নাই। এ কেবল একটা কালো ক্ষুধা, এ আমাকে অল্প অল্প করিয়া লেহন করিতে থাকিবে এবং ক্ষয় করিয়া ফেলিবে । ইহার রস জারক রস, তাহা নিঃশব্দে জীর্ণ করে । ঘুমাইতে পারিলে বীচি ; আমার জাগ্ৰংচৈতন্য এত বড়ো সর্বনাশা অন্ধকারের নিবিড় আলিঙ্গন সহিতে পারে না, এ কেবল মৃত্যুরই সহে। ] জানি না কতক্ষণ পরে-সেটা বােধ করি ঠিক ঘুম নয়- অসাড়তার একটা পাতলা চাদর আমার চেতনার উপরে ঢাকা পড়িল ৷ এক সময়ে সেই তন্দ্রবেশের ঘোরে আমার পায়ের কাছে প্ৰথমে একটা ঘন নিশ্বাস অনুভব করিলাম। ভয়ে আমার শরীর হিম হইয়া গেল। সেই আদিম জন্তুটা ! তার পরে কিসে আমার পা জড়াইয়া ধরিল। প্রথমে ভাবিলাম কোনো একটা বুনো জন্তু। কিন্তু তাদের গায়ে তো রোয়া আছে-এর রোয়া নাই। আমার সমস্ত শরীর যেন কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। মনে হইল একটা সাপের মতো জন্তু, তাহাকে চিনি না। তার কী রকম মুণ্ড, কী রকম গা, কী রকম লেজ কিছুই জানা নাই- তার গ্রাস করিবার প্রণালীটাি কী ভাবিয়া পাইলাম না। সে এমন নরম বলিয়াই এমন বীভৎস, সেই ক্ষুধার পুঞ্জ ! / ভয়ে ঘূণায় আমার কণ্ঠ রোধ হইয়া গেল। আমি দুই পা দিয়া তাহাকে ঠেলিতে লাগিলাম। মনে হইল সে আমার পায়ের উপর মুখ রাখিয়ছে-ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতেছে—সে যে কী রকম মুখ । জানি না। আমি পা ছুড়িয়া ষ্টুড়িয়া লাথি মারিলাম। অবশেষে আমার ঘোরটা ভাঙিয়া গেল। প্ৰথমে ভাবিয়ছিলাম। তার গায়ে রোয়া নাই, কিন্তু হঠাৎ অনুভব করিলাম, আমার পায়ের উপর একরাশি কেশর আসিয়া পড়িয়াছে। ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম । অন্ধকারে কে চলিয়া গেল । একটা কী যেন শব্দ শুনিলাম । সে কি চাপা কান্না ? ?