পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি ২৯১ বালিকা কোথা হইতে সর্বাঙ্গে রাজ্যের লজ্জা জড়াইয়া আনিয়া পানের বাট হাতে অনুকুলবাবুর কাছে আসিয়া দাড়াইল । তিনি কহিলেন, “লজ্জা কী, মা । বাটা ওই ওঁদের সামনে রাখো ।” বালিকা নত হইয়া কম্পিতহস্তে পানের কাটা অতিথিদের আসন-পাশ্বে ভূমিতে রাখিয়া দিল । বারান্দার পশ্চিম-প্রাস্ত হইতে সূর্যাস্ত-আভা তাহার লজ্জিত মুখকে মণ্ডিত করিয়া গেল। সেই অবকাশে মহেন্দ্র সেই কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখিয়া লইল । বালিকা তখনি চলিয়া যাইতে উষ্ঠত হইলে অমুকুলবাবু কহিলেন, “একটু দাড়া, চুনি। বিহারীবাবু, এইটি আমার ছোটো ভাই অপূর্বর কন্যা । সে তো চলিয়া গেছে, এখন আমি ছাড়া ইহার আর কেহ নাই ।” বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন । মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগিল । অনাথার দিকে আর-একবার চাহিয়া দেখিল । কেহ তাহার বয়স স্পষ্ট করিয়া বলিত না । আত্মীয়েরা বলিত, “এই বারোতেরো হইবে।” অর্থাৎ চৌদ-পনেরো হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক । কিন্তু অনুগ্রহপালিত বলিয়া একটি কুষ্ঠিত ভীরু ভাবে তাহার নবযৌবনারম্ভকে সংযত সংবৃত করিয়া রাখিয়াছে। আৰ্দ্ৰচিত্ত মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কী ” অমুকুলবাবু উৎসাহ দিয়া কহিলেন, “বলে মা, তোমার নাম বলে ।” বালিকা তাহার অভ্যস্ত আদেশপালনের ভাবে নতমুখে বলিল, “আমার নাম আশালতা।” আশা ! মহেন্দ্রের মনে হইল নামটি বড়ো করুণ এবং কণ্ঠটি বড়ো কোমল । অনাথা আশা ! দুই বন্ধু পথে বাহির হইয়া আসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল । মহেন্দ্ৰ কহিল, “বিহারী, এ মেয়েটিকে তুমি ছাড়িয়ে না।” বিহারী তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “মেয়েটিকে দেখিয়া উহার মাসিমাকে মনে পড়ে ; বোধ হয় আমনি লক্ষ্মী হইবে ।” মহেন্দ্র কহিল, “তোমার স্কন্ধে যে বোঝা চাপাইলাম, এখন বোধ হয় তাহার ভার তত গুরুতর বোধ হইতেছে না।” বিহারী কহিল, "না, বোধ হয় সহ করিতে পারিব।” মহেন্দ্ৰ কহিল, “কাজ কী এত কষ্ট করিয়া । তোমার বোঝা না হয় আমিই স্কন্ধে তুলিয়া লই। কী বল।”