পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি &8 & আশা তাহার কুসুম-সুকুমার করপল্লব মহেন্দ্রের মুখের উপর চাপ দিয়া কহিল, “না, না, অমন কথা বলিয়ে না । তুমি কোনো অপরাধ কর নাই। সকল দোষ আমার । আমাকে তোমার দাসীর মতো শাসন করো। আমাকে তোমার চরণাশ্রয়ের যোগ্য করিয়া লও।” বিদায়ের প্রভাতে শয্যাত্যাগ করিবার সময় মহেন্দ্ৰ কহিল, "চুনি, আমার রত্ন, তোমাকে আমার হৃদয়ে সকলের উপরে ধারণ করিয়া রাখিব, সেখানে কেহ তোমাকে ছাড়াইয়া যাইতে পারিবে না।” তখন আশা দৃঢ়চিত্তে সর্বপ্রকার ত্যাগস্বীকারে প্রস্তুত হইয়া স্বামীর নিকট নিজের একটিমাত্র ক্ষুদ্র দাবি দাখিল করিল। কহিল, “তুমি আমাকে রোজ একখানি করিয়া চিঠি দিবে ?: মহেন্দ্ৰ কহিল, “তুমিও দিবে ?” আশা কহিল, “আমি কি লিখিতে জানি ।” মহেন্দ্র তাহার কানের কাছে অলকগুচ্ছ টানিয়া দিয়া কহিল, “তুমি অক্ষয়কুমার দত্তের চেয়ে ভালো লিপিতে পার— চারুপাঠ যাহাকে বলে ।” আশা কহিল, “যাও, আমাকে আর ঠাট্টা করিয়ো না ।” যাইবার পূর্বে আশা যথাসাধ্য নিজের হাতে মহেন্দ্রের পোর্টম্যাণ্টো সাজাইতে বসিল । মহেন্দ্রের মোটা মোটা শীতের কাপড় ঠিকমতো ভাজ করা কঠিন, বাক্সে ধরানো শক্ত— উভয়ে মিলিয়া কোনোমতে চাপাচাপি ঠাসাঠুসি করিয়া, যাহা এক বাক্সে ধরিত, তাহাতে দুই বাক্স বোঝাই করিয়া তুলিল । তবু যাহা ভুলক্রমে বাকি রহিল, তাহাতে আরো অনেকগুলি স্বতন্ত্র পুটুলির স্বষ্টি হইল । ইহা লইয়া আশা যদিও বার বার লজ্জাবোধ করিল, তবু তাহাদের কাড়াকাড়ি, কৌতুক ও পরস্পরের প্রতি সহাস্ত দোষারোপে পূর্বেকার আনন্দের দিন ফিরিয়া আসিল । এ ষে বিদায়ের আয়োজন হইতেছে, তাহা আশা ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়া গেল । সহিস দশবার গাড়ি তৈয়ারির কথা মহেন্দ্রকে স্মরণ করাইয়া দিল, মহেন্দ্র কানে তুলিল না— অবশেষে বিরক্ত হইয়া বলিল, “ঘোড়া খুলিয়া দাও।” সকাল ক্রমে বিকাল হইয়া গেল, বিকাল সন্ধ্যা হয়। তখন স্বাস্থ্যপালন করিতে পরম্পরকে সতর্ক করিয়া দিয়া এবং নিয়মিত চিঠিলেখা সম্বন্ধে বারংবার প্রতিশ্রুত করাইয়া লইয়া ভারাক্রাস্ত হৃদয়ে পরস্পরের বিচ্ছেদ হইল । রাজলক্ষ্মী অাজ দুই দিন হইল উঠিয়া বসিয়াছেন। সন্ধ্যাবেলায় গায়ে মোট কাপড় মুড়ি দিয়া বিনোদিনীর সঙ্গে তাস থেলিতেছেন। আজ র্তাহার শরীরে কোনো গ্লানি