পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী ساهها এমন কুলক্ষণ দেবর পাইয়াও তাহাকে আদর করিতে শিখিলি না— তোরই কপাল মন্দ । বিহারী ! তোমার যদি তাহাতে দয়া হয় বিনোদ-বোঠান, তবে আর আমার আক্ষেপ কিসের । বিনোদিনী । সমুদ্র তো পড়িয়া আছে, তবু মেঘের ধারা নইলে চাতকের তৃষ্ণ মেটে না কেন । আশাকে ধরিয়া রাখা গেল না । সে জোর করিয়া বিনোদিনীর হাত ছাড়াইয়া বাহির হইয়া গেল। বিহারীও চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিল। বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, মহেন্দ্রবাবুর কী হইয়াছে, বলিতে পার ?” শুনিয়াই বিহারী থমকিয়া ফিরিয়া দাড়াইল । কহিল, “তাহা তো জানি না। কিছু হইয়াছে নাকি ৷” বিনোদিনী । কী জানি ঠাকুরপো, আমার তো ভালো বোধ হয় না । বিহারী উদবিগ্ন মুখে চৌকির উপর বসিয়া পড়িল। কথাটা খোলসা শুনিবে বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে ব্যগ্রভাবে চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া রহিল। বিনোদিনী কোনো কথা না বলিয়া মনোযোগ দিয়া চাদর সেলাই করিতে লাগিল । কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া বিহারী কহিল, “মহিনদার সম্বন্ধে তুমি কি বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিয়াছ ।” বিনোদিনী অত্যন্ত সাধারণ ভাবে কহিল, "কী জানি ঠাকুরপো, আমার তো ভালো বোধ হয় না। আমার চোখের বালির জন্যে আমার কেবলি ভাবনা হয় । বলিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সেলাই রাথিয়া উঠিয়া যাইতে উদ্যত হইল । বিহারী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “বোঠান, একটু বসে৷ ” বলিয়া একটা চেকিতে বসিল । বিনোদিনী ঘরের সমস্ত জানালা-দরজা সম্পূর্ণ খুলিয়া দিয়া কেরোসিনের বাতি উসকাইয়া সেলাই টানিয়া লইয়া বিছানার দূরপ্রাস্তে গিয়া বসিল । কহিল, “ঠাকুরপো, আমি তো চিরদিন এখানে থাকিব না— কিন্তু আমি চলিয়া গেলে আমার চোখের বালির উপর একটু দৃষ্টি রাখিয়ো— সে যেন অইখী না হয়।" বলিয়া যেন হৃদয়োচ্ছাস ংবরণ করিয়া লইবার জন্য বিনোদিনী অন্য দিকে মুখ ফিরাইল । বিহারী বলিয়া উঠিল, “বোঠান, তোমাকে থাকিতেই হইবে । তোমার নিজের বলিতে কেহ নাই— এই সরলা মেয়েটিকে স্বথে দুঃখে রক্ষা করিবার ভার তুমি লও— তুমি তাহাকে ফেলিয়া গেলে আমি তো আর উপায় দেখি না ।”