পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

&Oe রবীন্দ্র-রচনাবলা যাওয়া যায় তবে সেও ভালো । অপর ব্যক্তির কোলে-পিঠে চড়িয়া অগ্রসর হওয়ার কোনো মাহাত্ম্য নাই— কারণ, চলিবার শক্তিলাভই যথার্থ লাভ, অগ্রসর হওয়ামাত্রই লাভ নহে। ব্রিটিশ-রাজ্যে আমরা যেটুকু অগ্রসর হইতে পারিয়াছি তাহাতে আমাদের কৃতকাৰ্ধতা কতটুকু ! সেখানকার শাসনরক্ষণ-বিধিব্যবস্থা যত ভালোই হউক না কেন, তাহা তো বস্তুত আমাদের নহে। মানুষ ভুলত্রুটি-ক্ষতিক্লেশের মধ্য দিয়াই পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু আমাদিগকে ভুল করিতে দিবার ধৈর্ষ যে ব্রিটিশ-রাজের নাই । স্বতরাং তাহারা আমাদিগকে ভিক্ষণ দিতে পারেন, শিক্ষণ দিতে পারেন না। র্তাহীদের নিজের যাহা অাছে তাহার সুবিধা আমাদিগকে দিতে পারেন, কিন্তু তাহার স্বত্ব দিতে পারেন না । মনে করা যাক, কলিকাতা মুনিসিপ্যালিটির পূর্ববর্তী কমিশনারগণ পৌরকার্ষে স্বাধীনতা পাইয়া যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখাইতে পারেন নাই, সেই অপরাধে অধীর হইয়া কতৃপক্ষ তাহাদের স্বাধীনতা হরণ করিলেন । হইতে পারে এখন কলিকাতার পৌরকার্ব পূর্বের চেয়ে ভালোই চলিতেছে, কিন্তু এরূপ ভালো চলাই যে সর্বাপেক্ষ ভালো, তাহা বলিতে পারি না । আমাদের নিজের শক্তিতে ইহা অপেক্ষা খারাপ চলাও আমাদের পক্ষে ইহার চেয়ে ভালো । আমরা গরিব এবং নানা বিষয়ে অক্ষম ; আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্য ধনী জ্ঞানী বিলাতের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত তুলনীয় নহে বলিয়া শিক্ষাবিভাগে দেশীয় লোকের কতৃত্ব খর্ব করিয়া রাজা যদি নিজের জোরে কেমব্রিজঅক্সফোর্ডের নকল প্রতিমা গড়িয়া তোলেন, তবে তাহাতে আমাদের কতটুকুই বা শ্ৰেয় আছে— আমরা গরিবের যোগ্য বিদ্যালয় যদি নিজে গড়িয়া তুলিতে পারি তবে সেই আমাদের সম্পদ। যে-ভালো আমার আয়ত্ত ভালো নহে সে-ভালোকে আমার মনে করাই মানুষের পক্ষে বিষম বিপদ । অল্পদিন হইল একজন বাঙালি ডেপুটিম্যাজিস্টেট দেশীয় রাজ্যশাসনের প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেছিলেন– তখন স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম, তিনি মনে করিতেছেন, ব্রিটিশ-রাজ্যের স্থব্যবস্থা সমস্তই যেন তাহাদেরই স্থব্যবস্থা ; তিনি যে ভারবাহীমাত্র, তিনি যে যন্ত্ৰী নহেন, যন্ত্রের একটা সামান্ত অঙ্গমাত্র, এ-কথা যদি তাহার মনে থাকিত তবে দেশীয় রাজ্যব্যবস্থার প্রতি এমন স্পর্ধার সহিত অবজ্ঞা প্রকাশ করিতে পারিতেন না। ব্রিটিশ-রাজ্যে আমরা যাহা পাইতেছি তাহা যে আমাদের নহে, এই সত্যটি ঠিকমতো বুঝিয়া উঠা আমাদের পক্ষে কঠিন হইয়াছে, এই কারণেই আমরা রাজার নিকট হইতে ক্রমাগত্তই নূতন নূতন অধিকার প্রার্থনা করিতেছি এবং ভুলিয়া যাইতেছি— অধিকার পাওয়া এবং অধিকারী হওয়া একই কথা নহে ।