পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ૨૭ (:

  • ওমা! সে কী কথা ! এ তো তোমারই বাপের বিষয়, আর হরিদাস তো তোমারই আপন ছেলের তুল্য। ওকে বিষয় লিখিয়া দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তুমি রাগ কর কেন !”

হায় হায়, তাহার স্বামীর হৃদয় কী কঠিন । এই কচি ছেলের উপরেও ঈর্ষা করিতে তাহার মন ওঠে ? তাহার শ্বশুর যে উইলটি লিখিয়াছে কিরণ মনে মনে তাহার সম্পূর্ণ সমর্থন করে । তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস, বনোয়ারির হাতে যদি বিষয় পড়িত তবে রাজ্যের যত ছোটোলোক, যত যদু মধু, যত কৈবর্ত এবং মুসলমান জোলার দল তাহাকে ঠকাইয়। কিছু আর বাকি রাখিত না এবং হালদার-বংশের এই ভাবী আশা একদিন অকুলে ভাসিত। শ্বশুরের কুলে বাতি জালিবার দীপটি তো ঘরে আলিয়াছে, এখন তাহার তৈলসঞ্চয় যাহাতে নষ্ট না হয় নীলকণ্ঠই তো তাহার উপযুক্ত প্রহরী। বনোয়ারি দেখিল, নীলকণ্ঠ অন্তঃপুরে আসিয়া ঘরে ঘরে সমস্ত জিনিসপত্রের লিস্ট, করিতেছে এবং যেখানে যত লিন্দুক-বাক্স আছে তাহাতে তালাচাবি লাগাইতেছে। অবশেষে কিরণের শোবার ঘরে আলিয়া সে বনোয়ারির নিত্যৰ্যবহার্য সমস্ত দ্রব্য ফর্দভূক্ত করিতে লাগিল । নীলকণ্ঠের অন্তঃপুরে গতিবিধি আছে, সুতরাং কিরণ তাহাকে লজ্জা করে না। কিরণ শ্বশুরের শোকে ক্ষণে ক্ষণে অশ্র মুছিবার অবকাশে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বিশেষ করিয়া সমস্ত জিনিস বুঝাইয়া দিতে লাগিল । বনোয়ারি সিংহগর্জনে গজিয়া উঠিয়া নীলকণ্ঠকে বলিল, “তুমি এখনি আমার ঘর হইতে বাহির হইয়া যাও !” নীলকণ্ঠ নম্র হইয়া কহিল, "বড়োবাবু, আমার তো কোনো দোষ নাই । কর্তার উইল-অনুসারে আমাকে তো সমস্ত বুঝিয়া লইতে হইবে। আসবাবপত্র সমস্তই তো হরিদাসের ।” কিরণ মনে মনে কহিল, "দেখে একবার, ব্যাপারখানা দেখো । হরিদাস কি আমাদের পর । নিজের ছেলের সামগ্ৰী ভোগ করিতে আবার লজ্জা কিসের। আর, জিনিসপত্র মানুষের সঙ্গে যাইবে না কি। আজি না হয় কাল ছেলেপুলেরাই তো ভোগ করিবে ।” এ বাড়ির মেঝে বনোয়ারির পায়ের তলায় কাটার মতো বিধিতে লাগিল, এ বাড়ির দেয়াল তাহার দুই চক্ষুকে যেন দধ করিল । তাহার বেদন যে কিসের তাহা বলিবার লোক ও এই বৃহৎ পরিবারে কেহ নাই । এই মুহূর্তেই বাড়িঘর সমস্ত ফেলিয়া বাহির হইয়া যাইবার জন্ত বনোয়ারির মন ব্যাকুল হইয়া উঠিল। কিন্তু, তাহার রাগের জালা যে থামিতে চায় না। সে চলিয়া