পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ २२> বস্তুত, আমার শ্বশুর ব্রাহ্ম ও নন, খৃস্টান ও নন, হয়তো বা নাস্তিকও না হইবেন । দেবার্চনার কথা কোনোদিন তিনি চিন্তা ও করেন নাই । মেয়েকে তিনি অনেক পড়াইয়াছেন-শুনাইয়াছেন, কিন্তু কোনোদিনের জন্য দেবতা সম্বন্ধে তিনি তাহাকে কোনো উপদেশ দেন নাই । বনমালীবাবু এ লইয়া তাহাকে একবার প্রশ্ন করিয়াছিলেন । তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি মাহা বুঝি না তাহা শিখাইতে গেলে কেবল কপটতা শেখানে হইবে।” অন্তঃপুরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল, সে আমার ছোটো বোন নারানী । বউদিদিকে ভালোবাসে বলিয়া তাহাকে অনেক গঞ্জন সহিতে হইয়াছিল । সংসারযাত্রায় হৈমর সমস্ত অপমানের পাল আমি তাহার কাছেই শুনিতে পাইতাম । একদিনের জন্য ও আমি হৈমর কাছে শুনি নাই। এ-সব কথা সংকোচে সে মুখে আনিতে পারিত না । সে সংকোচ নিজের জন্য নহে । হৈম তাহার বাপের কাছ হইতে যত চিঠি পাইত সমস্ত আমাকে পড়িতে দিত। চিঠিগুলি ছোটো কিন্তু রসে ভরা। সেও বাপকে যত চিঠি লিখিত সমস্ত আমাকে দেখাইত । বাপের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটিকে আমার সঙ্গে ভাগ করিয়া না লইলে তাহার দাম্পত্য যে পুর্ণ হইতে পারিত না । তাহার চিঠিতে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে কোনো নালিশের ইশারাটুকুও ছিল না। থাকিলে বিপদ ঘটিতে পারিত। নারানীর কাছে শুনিয়াছি, শ্বশুরবাড়ির কথা কী লেখে জানিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার চিঠি খোলা হইত। চিঠির মধ্যে অপরাধের কোনো প্রমাণ না পাইয়া উপরওয়ালাদের মন যে শাস্ত হইয়াছিল তাহা নহে। বোধ করি তাহাতে র্তাহার। আশাভঙ্গের দুঃখই পাইয়াছিলেন । বিষম বিরক্ত হইয়। র্তাহার। বলিতে লাগিলেন, “এত ঘন ঘন চিঠিই বা কিসের জন্ত ? বাপই যেন সব, আমরা কি কেহ নই।” এই লইয়া অনেক অপ্রিয় কথা চলিতে লাগিল। আমি ক্ষুব্ধ হইয়া হৈমকে বলিলাম, “তোমার বাবার চিঠি আর-কাহাকেও না দিয়া আমাকেই দিয়ে । কলেজে যাইবার সময় আমি পোস্ট করিয়া দিব।” হৈম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, "কেন ?” আমি লজ্জায় তাহার উত্তর দিলাম না। বাড়িতে এখন সকলে বলিতে আরম্ভ করিল, “এইবার অপুর মাথা খাওয়া হইল। বি. এ. ডিগ্রি শিকায় তোলা রহিল । ছেলেরই বা দোষ কী ।” সে তো বটেই। দোষ সমস্তই হৈমর । তাহার দোষ যে তাহার বয়স সতেরো ; তাহার দোষ যে আমি তাহাকে ভালোবাসি ; তাহার দোষ যে বিধাতার এই বিধি, তাই আমার হৃদয়ের রন্থে রন্থে, সমস্ত আকাশ আজ বাশি বাজাইতেছে।