পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

रै२४” রবীন্দ্র-রচনাবলী চুপ করিয়া রহিল ষে বাবা বুঝিলেন, তাহার সদুপদেশটা একেবারে বাজে খরচ श्झेल । হৈমর দুর্গতিতে দুঃখ করিব কী, তাহার কাছে আমার মাথা হেঁট হইয়া গেল । সেদিন দেখিলাম, শরৎপ্ৰভাতের আকাশের মতো তাহার চোখের সেই সরল উদার দৃষ্টি একটা কী সংশয়ে স্নান হইয়া গেছে। ভীত হরিণীর মতো লে আমার মুখের দিকে চাহিল। ভাবিল, “আমি ইহাদিগকে চিনি না।’ সেদিন একখানা শৌখিন-বাধাই-করা ইংরাজি কবিতার বই তাহার জন্য কিনিয়া আনিয়াছিলাম। বইখানি সে হাতে করিয়া লইল এবং আস্তে আস্তে কোলের উপর রাখিয়া দিল, একবার খুলিয়া দেখিল না । আমি তাহার হাতখানি তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, "হৈম, আমার উপর রাগ করিয়ো না। আমি তোমার সত্যে কখনো আঘাত করিব না, আমি যে তোমার সত্যের বাধনে বাধা ।” হৈম কিছু না বলিয়া একটুখানি হাসিল । সে হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার কোনো কথা বলিবার দরকার নাই । পিতার আর্থিক উন্নতির পর হইতে দেবতার অনুগ্রহকে স্থায়ী করিবার জন্য নূতন উৎসাহে আমাদের বাড়িতে পূজাৰ্চনা চলিতেছে। এ পর্যস্ত সে-সমস্ত ক্রিয়াকর্মে বাড়ির বধুকে ডাক পড়ে নাই। নূতন বধূর প্রতি একদিন পূজা সাজাইবার আদেশ হইল ; সে বলিল, “মা, বলিয়া দাও কী করিতে হইবে।” ইহাতে কাহারও মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িবার কথা নয়, কারণ সকলেরই জানা ছিল, মাতৃহীন প্রবাসে কন্যা মানুষ । কিন্তু কেবলমাত্র হৈমকে লজ্জিত করাই এই আদেশের হেতু । সকলেই গালে হাত দিয়া বলিল, “ওমা, এ কী কাও । এ কোন নাস্তিকের ঘরের মেয়ে । এবার এ সংসার হইতে লক্ষ্মী ছাড়িল, আর দেরি নাই।” এই উপলক্ষ্যে হৈমর বাপের উদ্দেশে যাহা-না-বলিবার তাহা বলা হইল। যখন হইতে কটুকথার হাওয়া দিয়াছে, হৈম একেবারে চুপ করিয়া সমস্ত সহ করিয়াছে। একদিনের জন্ত কাহারও সামনে সে চোখের জলও ফেলে নাই । আজ তাহার বড়ো বড়ো দুই চোখ ভাসাইয়া দিয়া জল পড়িতে লাগিল । সে উঠিয়া দাড়াইয়া বলিল, *আপনারা জানেন— সে দেশে আমার বাবাকে সকলে ঋষি বলে ?” ঋষি বলে ! ভারি একটা হাসি পড়িয়া গেল। ইহার পরে তাহার পিতার উল্লেখ করিতে হইলে প্রায়ই বলা হইত, তোমার ঋষিবাবা ! এই মেয়েটির সকলের চেয়ে দরদের জায়গাটি যে কোথায় তাহা আমাদের সংসার বুঝিয়া লইয়াছিল।