পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७e ॐ রবীন্দ্র-রচনাবলী 8 কিন্তু, কথা এমন করিয়া ফুরাইল না । যেখানে আলিয় তাহ অফুরান হইয়াছে সেখানকার বিবরণ একটুখানি বলিয়া আমার এ লেখা শেষ করিয়া দিই। মাকে লইয়া তীর্থে চলিয়াছিলাম। আমার উপরেই ভার ছিল। কারণ, মামা এবারেও হাবড়ার পুল পার হন নাই। রেলগাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। ঝণকানি খাইতে থাইতে মাথার মধ্যে নানাপ্রকার এলোমেলে স্বপ্নের ঝুমঝুমি বাজিতেছিল। হঠাৎ একটা কোন স্টেশনে জাগিয়া উঠিলাম। আলোতে অন্ধকারে মেশা সেও এক স্বপ্ন ; কেবল আকাশের তারাগুলি চিরপরিচিত— আর সবই অজানা অস্পষ্ট ; স্টেশনের দীপ-কয়টা খাড়া হইয়া দাড়াইয়া আলো ধরিয়া এই পৃথিবীট। যে কত অচেনা, এবং যাহা চারি দিকে তাহ যে কতই বহুদূরে, তাহাই দেখাইয়া দিতেছে। গাড়ির মধ্যে মা ঘুমাইতেছেন ; আলোর নিচে সবুজ পর্দা টান ; তোরঙ্গ বাক্স জিনিসপত্র সমস্তই কে কার ঘাড়ে এলোমেলো হইয়া রহিয়াছে, তাহারা যেন স্বপ্নলোকের উলটপালট আসবাব, সবুজ প্রদোষের মিটুমিটে আলোতে থাকা এবং না-থাকার মাঝখানে কেমন-একরকম হইয়া পড়িয়া আছে । এমন সময়ে সেই অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত রাত্রে কে বলিয়া উঠিল, “শিগগির চলে আয়, এই গাড়িতে জায়গা আছে।” মনে হইল, যেন গান শুনিলাম। বাঙালি মেয়ের গলায় বাংলা কথা যে কী মধুর তাহা এমনি করিয়া অসময়ে অজায়গায় আচমকা শুনিলে তবে সম্পূর্ণ বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু, এই গলাটিকে কেবলমাত্র মেয়ের গলা বলিয়া একটা শ্রেণীভুক্ত করিয়া দেওয়া চলে না, এ কেবল একট-মামুষের গলা ; শুনিলেই মন বলিয় ওঠে, এমন তো আর শুনি নাই।’ চিরকাল গলার স্বর আমার কাছে বড়ো সত্য । রূপ জিনিসটি বড়ো কম নয় কিন্তু মামুষের মধ্যে যাহা অন্তরতম এবং অনির্বচনীয়, আমার মনে হয়, কণ্ঠস্বর যেন তারই চেহারা। আমি তাড়াতাড়ি গাড়ির জানলা খুলিয়া বাহিরে মুখ বাড়াইয়া দিলাম ; কিছুই দেখিলাম না। প্ল্যাটফর্মের অন্ধকারে দাড়াইয়া গার্ড তাহার একচক্ষু লণ্ঠন নাড়িয়া জিল, গাড়ি চলিল; আমি জানলার কাছে বসিয়া রহিলাম। আমার চোখের সামনে কোনো মূর্তি ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের মধ্যে আমি একটি হৃদয়ের রূপ দেখিতে লাগিলাম। সে যেন এই তারাময়ী রাত্রির মতো, আবৃত করিয়া ধরে কিন্তু তাহাকে ধরিতে পারা যায় না। ওগো স্বর, অচেনা কণ্ঠের স্বর, এক নিমেষে তুমি ষে আমার চিরপরিচয়ের আসনটির উপরে আসিয়া বলিয়াছ। কী আশ্চর্য পরিপূর্ণ