পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ \ტo S একদিন নিরালা দুপুরবেলায় সে কি সেটি খুলিয়া দেখে না। যখন ঝুকিয়া পড়িয়া দেখে তখন ছবিটির উপরে কি তার মুখের দুই ধার দিয়া এলোচুল আসিয়া পড়ে না। হঠাৎ বাহিরে কারও পায়ের শব্দ পাইলে সে কি তাড়াতাড়ি তার সুগন্ধ আঁচলের মধ্যে ছবিটিকে লুকাইয়া ফেলে না । দিন যায়। একটা বৎসর গেল। মামা তো লজ্জায় বিবাহসম্বন্ধের কথা তুলিতেই পারেন না। মার ইচ্ছা ছিল, আমার অপমানের কথা যখন সমাজের লোকে ভুলিয়া যাইবে তখন বিবাহের চেষ্টা দেখিবেন । এদিকে আমি শুনিলাম, সে মেয়ের নাকি ভালো পাত্র জুটিয়াছিল কিন্তু সে পণ করিয়াছে, বিবাহ করিবে না। শুনিয়া আমার মন পুলকের আবেশে ভরিয়া গেল। আমি কল্পনায় দেখিতে লাগিলাম, সে ভালো করিয়া খায় না ; সন্ধ্যা হইয়া আসে, সে চুল বাধিতে ভুলিয়া যায় । তার বাপ তার মুখের পানে চান আর ভাবেন, ‘আমার মেয়ে দিনে দিনে এমন হুইয়। যাইতেছে কেন ? হঠাৎ কোনোদিন তার ঘরে আসিয়া দেখেন, মেয়ের দুই চক্ষু জলে ভরা। জিজ্ঞাসা করেন, ‘ম, তোর কী হইয়াছে বল আমাকে ।’ মেয়ে তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া বলে, “কই, কিছুই তো হয় নি, বাবা।” বাপের এক মেয়ে যে— বড়ো অাদরের মেয়ে । যখন অনাবৃষ্টির দিনের ফুলের কুঁড়িটির মতো মেয়ে একেবারে বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে তখন বাপের প্রাণে আর সহিল না । তখন অভিমান ভাসাইয়া দিয়া তিনি ছুটিয়া আসিলেন আমাদের দ্বারে । তার পরে ? তার পরে মনের মধ্যে সেই যে কালো রঙের ধারাটা বহিতেছে সে ধেন কালো সাপের মতে রূপ ধরিয়া ফেঁাস করিয়া উঠিল । সে বলিল, “বেশ তো, আর-একবার বিবাহের আসর সাজানো হোক, আলো জলুক, দেশ-বিদেশের লোকের নিমন্ত্রণ হোক, তার পরে তুমি বরের টোপর পায়ে দলিয়া দলবল লইয়া সভা ছাড়িয়া চলিয়া এসো।” কিন্তু, যে ধারাটি চোখের জলের মতো শুভ্র সে রাজহংসের রূপ ধরিয়া বলিল, "যেমন করিয়া আমি একদিন দময়ন্তীর পুষ্পবনে গিয়াছিলাম তেমনি করিয়া অামাকে একবার উড়িয়া যাইতে দাও— আমি বিরহিণীর কানে কানে একবার স্বখের খবরটা দিয়া আসি গে।’ তার পরে ? তার পরে দুঃখের রাত পোহাইল, নববর্ষার জল পড়িল, মান ফুলটি মুখ তুলিল— এবারে সেই দেয়ালটার বাহিরে রহিল সমস্ত পৃথিবীর আর-সবাই, আর ভিতরে প্রবেশ করিল একটিমাত্র মানুষ। তার পরে ? তার পরে আমার কথাটি ফুরালো ।