পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে \©ჯრ) রসবিচারে ব্যক্তিগত এবং কালগত ভুল সংশোধন করিয়া লইবার জন্ত বহু ব্যক্তি ও দীর্ঘ সময়ের ভিতর দিয়া বিচার্য পদার্থটিকে বহিয়া লইয়া গেলে তবে সন্দেহ মেটে । কোনো কবির রচনার মধ্যে সাহিত্যবস্তুটা আছে কি না তাহার উপযুক্ত সমজদার কবির সমসাময়িকদের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক আছে, কিন্তু তাহারাই উপযুক্ত কি না তাহার চূড়ান্ত নিম্পত্তি দাবি করিলে ঠকা অসম্ভব নয়। এমন অবস্থায় লেখকের একটা সুবিধা আছে এই যে, তাহার লেখা ষে-লোক পছন্দ করে সেই যে সমজদার তাহ ধরিয়া লইতে বাধা নাই । অপর পক্ষকে তিনি যদি উপযুক্ত বলিয়া গণ্যই না করেন তবে এমন বিচারালয় হাতের কাছে নাই যেখানে তাহার নালিশ রুজু করিতে পারে। অবশ্য, কালের আদালতে ইহার বিচার চলিতেছে, কিন্তু সেই দেওয়ানি আদালতের মতো দীর্ঘস্থত্রী আদালত ইংরেজের মুল্লুকেও নাই । এস্থলে কবিরই জিত রহিল, কেননা আপাতত দখল যে তাহারই । কালের পেয়াদা যেদিন তাহার খ্যাতি-সীমানার খুটি উপড়াইতে আসিবে সেদিন সমালোচক সেই তামাশা দেখিবার জন্য সবুর করিতে পারিবে না। যাহারা আধুনিক বঙ্গসাহিত্যে বাস্তবতার তল্লাল করিয়া একেবারে হতাশ্বাস হইয়। পডিয়াছেন তাহারা আমার কথার উত্তরে বলিবেন, ‘দাড়িপাল্লায় চড়াইয়া রস-জিনিসটার বস্তু পরিমাণ করা যায় না, এ কথা সত্য, কিন্তু রস-পদার্থ কোনো একটা বস্তুকে আশ্রয় করিয়া তো প্রকাশ পায়। সেইখানেই আমরা বাস্তবতার বিচার করিবার স্থযোগ পাইয়। থাকি ৷” নিশ্চয়ই রসের একটা আধার অাছে। সেটা মাপকাঠির আয়ত্তাধীন সন্দেহ নাই । কিন্তু, সেইটেরই বস্তুপিণ্ড ওজন করিয়া কি সাহিত্যের দর যাচাই হয়। রসের মধ্যে একটা নিত্যতা আছে। মাদ্ধাতার আমলে মানুষ যে-রসটি উপভোগ করিয়াছে আজও তাহা বাতিল হয় নাই। কিন্তু, বস্তুর দর বাজার-অনুসারে এবেলা ওবেলা বদল হইতে থাকে । আচ্ছা, মনে করা যাক, কবিতাকে বাস্তব করিবার লোভ আমি আর সামলাইতে পারিতেছি না। খুজিতে লাগিলাম, দেশে সব-চেয়ে কোন ব্যাপারটা বাস্তব হইয়া উঠিয়াছে । দেখিলাম, ব্রাহ্মণসভাটা দেশের মধ্যে রেলোয়ে-সিগ্নালের স্তম্ভটার মতো চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া আপনার একটিমাত্র পায়ে ভর দিয়া খুব উচু হইয়া দাড়াইয়াছে। কায়স্থের পৈতা লইবেই আর ব্রাহ্মণসভা তাহার পৈতা কাড়িবে, এই ঘটনাটা বাংলাদেশে বিশ্বব্যাপারের মধ্যে সব-চেয়ে বড়ো । অতএব, বাঙালি কবি যদি ইহাকে তাহার রচনায় আমল না দেয় তবে বুঝিতে হইবে, বাস্তবতা সম্বন্ধে তাহার বোধশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ।