পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা ৩২৩ মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে । সমস্ত দুপুরবেলা, খাওয়ার পর থেকেই, তার মনের মধ্যে একটা অস্থির অপেক্ষা ছিল কখন আসবে অমিত। কেবলই মন বলেছে এল বুঝি । বাইরে দমকা হাওয়ার দৌরাত্ম্যে পাইন গাছগুলো থেকে থেকে ছটফট করে, আর * দুর্দান্ত বৃষ্টিতে সদ্যোজ্যত ঝরনাগুলো এমনি ব্যতিব্যস্ত, যেন তাদের মেয়াদের সময়টার সঙ্গে উর্ধ্বশ্বাসে তাদের পাল্লা চলেছে। লাবণ্যর মধ্যে একটা ইচ্ছে আজ অশাস্ত হয়ে উঠল,-—যাক সব বাধা ভেঙে, সব দ্বিধা উড়ে, অমিতর দুই হাত আজ চেপে ধরে বলে উঠি—জন্মে-জন্মাস্তরে আমি তোমার। আজ বল সহজ । আজ সমস্ত আকাশ যে মরিয়া হয়ে উঠল, তৃত্ব করে কী যে হেঁকে উঠছে তার ঠিক নেই, তারই ভাষায় আজ বন-বনান্তর ভাষা পেয়েছে, বৃষ্টিধারায় আবিষ্ট গিরিশৃঙ্গগুলো আকাশে কান পেতে দাড়িয়ে রইল। অমনি করেই কেউ শুনতে আসুক লাবণ্যর কথা, অমনি মস্ত করে, স্তন্ধ হয়ে, আমনি উদার মনোযোগে । কিন্তু প্রহরের পর প্রহর যায়, কেউ আসে না। ঠিক মনের কথাটি বলার লগ্ন যে উত্তীর্ণ হয়ে গেল। এর পরে যপন কেউ আসবে তপন কথা জুটবে না, তপন সংশয় আসবে মনে, তপন তা গুবনুত্যোন্মত্ত দেবতার মাভৈঃ রব আকাশে মিলিয়ে যাবে । বংসরের পর বংসর নীরবে চলে যায়, তার মধ্যে বাণী একদিন বিশেষ প্রহরে হঠাং মানুষের দ্বারে এসে আঘাত করে । সেই সময়ে দ্বার পোলবার চাবিটি যদি না পাওয়া গেল, তবে কোনোদিনই ঠিক কথাটি অকুষ্ঠিত স্বরে বলবার দৈবশক্তি আর জোটে না । যেদিন সেই বাণী আসে সেদিন সমস্ত পৃথিবীকে ডেকে পবর দিতে ইচ্ছে করে—শোনো তোমরা, আমি ভালোবাসি । আমি ভালোবাসি, এই কথাটি অপরিচিত-সিন্ধুপারগামী পাপির মতে কত দিন থেকে, কত দূর থেকে আসছে, সেই কথাটির জন্যেই আমার প্রাণে আমার ইষ্টদেবতা এত দিন অপেক্ষা করছিলেন । স্পশ করল আজ সেই কথাটি,—আমার সমস্ত জীবন, আমার সমস্ত জগং সত্য হয়ে উঠল। বালিশের মধ্যে মুখ লুকিয়ে লাবণ্য আজ কাকে এমন করে বলতে লাগল, সত্য, সত্য, এত সত্য আর কিছু নেই। সময় চলে গেল, অতিথি এল না। অপেক্ষার গুরুভারে বুকের ভিতরটা টন টন করতে লাগল, বারান্দায় বেরিয়ে গিয়ে লাবণ্য খানিকটা ভিজে এল জলের ঝাপট লাগিয়ে । তার পরে একটা গভীর অবসাদে তার মনটাকে ঢেকে ফেললে, নিবিড় একটা নৈরাখে ; মনে হল ওর জীবনে যা জলবার তা একবার মাত্র দপ করে জলে তার পরে গেল নিবে, সামনে কিছুই নেই। অমিতকে নিজের ভিতরকার সত্যের দোহাই দিয়ে সম্পূর্ণ করে স্বীকার করে নিতে ওর সাহস চলে গেল। এই কিছু আগেই ওর প্রবল যে একটা ভরসা জেগেছিল সেটা ক্লাস্ত হয়ে পড়েছে। অনেকক্ষণ